ArabicBengaliEnglishHindi

মধ্যবিত্ত


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১১, ২০২২, ৬:৩৬ অপরাহ্ন / ৩৩০
মধ্যবিত্ত

মধ্যবিত্ত
মোঃ জাবেদুল ইসলাম

জসিম আহমেদ একজন পেশাদার রিকশা চালক।পরিবার স্ত্রী, ১ছেলে সন্তানকে নিয়ে ছোট একটা ভাড়া বাসায় থাকতো। জসিমের ছেলে নাম আকাশ, বয়স ৯ বছর হবে। জসিমের সংসারের একমাত্র আয় উৎস ছিল রিকশা চালানো আয়।রিকশা চালিয়ে যা রোজগার করতো তা দিয়ে কোন রকমের সংসার চলতো।

আকাশ ফুটফুটে মিষ্টি একটা শিশু। আকাশ মা-বাবা একমাত্র আদরের সন্তান । আদর ভালবাসা কোনটি কমটি ছিল না আকাশের। কিন্তু সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি। পরিবারের সকল নিত্যদিনের চাহিদা আর ছেলেটা চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জমিসের ! সারা দিনের ক্লান্ত শরীরের যখন রাতে বেলা বাসা ফিরানো হতো। তখন আকাশ দৌড়ে এসে বলতো বাবা আমার জন্য আজকে কি আনছেন বাবা ! জসিম আকাশের জন্য প্রতিদিন ভাল মজাদার সব চকলেট নিয়ে আসতো। সন্তানকে কুলে নিয়ে চকলেট দিয়ে সারা দিনের ক্লান্তের যেন তৃষ্ণা মেটাতো জসিম।

আকাশ বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো বাবা, আজকে আমার স্কুলের বন্ধুরা নতুন ড্রেজ পড়ে আরছে। আমারও নতুন ড্রেজ কিনে দাও না! বাবা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো কয়েকদিন পর স্কুলের জন্য নতুন ড্রেজ কিনে দিব বাবা। আকাশ বাবা জড়িয়ে ধরে বাবার মুখে একটা চুম্বন করলো। তারপর আম্মুকে ডাক দিয়ে বললেন – বাবা-সন্তানের আদর শেষ হলে টেবিলের খেতে বসো। আব্বু ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আমরা সবাই টেবিলে খেতে বসলাম। আম্মু প্রথমে আমার খাবারের থালা পরিষ্কার করে ভাত দিল। তারপর আব্বু নিজের খাবারের থালা পরিষ্কার করে ভাত নিল। আম্মু রান্না করছে আলু ভর্তা, ডাল, আর ডিম। মাস জুড়ে প্রতিদিন খেতে হচ্ছে আলু ভর্তা, ডাল, আর ডিম।

আমার প্রত্যেক দিন এই খাবার গুলো খেতে ভাল লাগে না। তাই মন খারাপ করে খাবারের থালা নিয়ে বসে আসি। আব্বু বিষয়টি লক্ষ্য করে বললো আমার আদরের আকাশ সোনা মন খারাপ কেনো? আমি আব্বুকে বললাম আমার প্রতিদিন এই খাবার গুলো ভাল লাগে না। আমি আর খাবার খাব না।আমি গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাবো আব্বুর!

ছেলের এমন কথা শুনের যেন মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আব্বুর দেখি মন খারাপ হয়ে গেছে। খাবার না খেয়ে বসে আছে। আম্মু বললো আজকে বাপ-বেটা কি হয়েছে ভাত খেয়ে নাও? আব্বু একটু খেয়ে বললো আর খাব না। শরীরে একটু খারাপ লাগতেছে। আব্বু মিষ্টি মুখে তাকিয়ে আমাকে বললো ঠিক আছে বাবা, এখনো খাবার খেয়ে নাও। দেখি আগামীকাল গরুর মাংস কিনে আনবো! আমি খাবার না খেয়ে থালায় পানি ঢেলে হাত ধুয়ে ঘুমানো জন্য চলে গেলাম।

আমার পিছনে আব্বু ও খাবার না খেয়ে চলে গেলো ঘুমানো জন্য আম্মু খাবারের টেবিল গুছিয়ে ঘুমানো জন্য রুমে এলো। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমের হতো হয়ে আছি আগামীকাল গরুর মাংস খাবো আনন্দের জন্য ঘুমাতে পারছিনা। আম্মু বাবাকে বললো আজকে কি আপনার শরীর খারাপ। আব্বু বললো না। তাহলে খাবার খাওনি যে কি করে খাবো বলো আকাশ বলছে গরু মাংস খেতে চেয়েছে। আমি বলছি আগামীকাল গরু মাংস কিনে আনবো। আমাদের ছেলে অনেক খুশি হয়েছে।ছেলের সেই খুশিটি কি আগামীকাল দেখতে পারবো? এই ভেবেই সারারাত ঘুমাতে পারিনি বাবা।

সকাল হলো আমি ঘুম থেকে ওঠে নূরানী মাদ্রসায় চলে গেলাম। মাদ্রসা থেকে এসে দেখি আব্বু বাসায় নেই। আম্মুকে বললাম আব্বু কোথায়? আম্মু বললো আব্বু নাকি আজকে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি তো খুশি আজকে গরু মাংস খাবো! তারপর চলে গেলাম স্কুলে। স্কুলের ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে এলাম। আজকে দিনটা যেন পৃথিবীর দীর্ঘতম দিন মনে হচ্ছে। কেনো দিনটা শেষ হচ্ছে না। কখন সন্ধ্যা হবে আব্বুর গরুর মাংস নিয়ে আসবে আর আম্মু রান্না করবে – আজকে সবাই মিলে গরুর মাংস খাবো। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হলো আমি আব্বুর আশার পথ চেয়ে আছি কখন আব্বু মাংস নিয়ে বাসা আসবে?

সন্ধ্যায় ফিরিয়ে রাত এলো আব্বু বাসা এলো তবে একলা না সাথে আব্বুর রিকশা চালক বন্ধু আমিন, জুয়েল চাচুরা ও ছিল। আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কুলে করে বাসা নিয়ে আসা হলো আমি আব্বুর কাছে দৌড়ে ছুটে গেলাম, দেখি পায়ের খুব ব্যাথা পেয়েছে নাকি দুপুরে। দুপুর থেকে আব্বু হাসপাতালে ছিল। আব্বুর রিকশা সাথে একটা ট্রাকের ধাঁক্কা লাগছে। ট্রাকটি নাকি আব্বুকে আর রিকশাটিকে ধাঁক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে। আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্নাতে লাগলো। এতো বড়ো একটা বিপদ হলো আমি জানি না। আজকে যদি আরো বড়ো কোন কিছু হয়ে যেত তাহলে আমাদের কি হতো, আমরা কি নিয়ে বাঁচবো।আম্মুর কান্না যেন চারিদিকের পরিবেশ ভারি হয়ে গেছে। আমি কান্না করতে ছিলাম। আব্বু আমাকে আর আম্মুকে ডেকে পাশে বসালো বললো আমি ঠিক আছি এইবার কান্না থামান।

আব্বু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে কান্না করতে লাগলো বাবা আজকে আমার সোনামণি জন্য গরুর মাংস আনতে পারিনি? আমার সোনামণি জন্য আগামীকাল গরুর মাংস আনবো। এখন লক্ষী ছেলে মতো কান্না বন্ধ করে ফ্রেস হয়ে নাও। আমি আব্বুর কথা শুনে হাত-মুখ ধুতে গেলাম।আম্মু আব্বুকে বললো এই সব কিভাবে হলো আব্বুর বললো গরীবের জীবনের কোন মূল্য নেই।আমরা মধ্যবিত্ত বলে “স্বপ্ন দেখতে জানি কিন্তু পূরণ করতে পারিনা”।

আমাদের সংসারের “নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়”।সেখানে ছেলে আবদার নতুন জমা আর গরুর মাংস। আমাদের সন্তানের চাহিদা পূরণ করার জন্য সকাল থেকে বিরতিহীন ভাবে রিকশা চালাছিলাম। তখন কোথায় থেকে যে একটি দ্রুতগামী ট্রাকটি সামনে চলে আসলো আমি খেয়াল করতে পারিনি। ট্রাকটি আমার রিকশা জোড়ে ধাক্কা দে।এতে আমি মুহুর্তে মধ্যে গাড়ি নিচে পড়ে যায়।আমার পা গাড়ির নিচে আটকে গেল। তারপর আমার আর কোন কিছু মনে নেই। আমি বাবা হয়েছে ছেলের আশা পূরণ করতে পারলাম না! এই বলে আব্বুর কান্না করতেছে আমি বাসা বাহিরে দাঁড়িয়ে আব্বুর সব কথা শুনতেছি। আজকে আমার জন্য আব্বুর এমন করুণ দশা।কি হবে এখন আমাদের? আম্মু আব্বুকে বললো কান্না করে ভেঙ্গে পড়লো কি হবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে? আল্লাহ যেন আপনাকে অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলো এটা জন্য আল্লাহ তা’আলা দরবারে শুকরিয়া জানাই।

আব্বু আম্মুকে বললো এখন আমাদের সংসারে কি হবে? কিভাবে আমাদের সংসার চলবে? ডাক্তার বলছে ২০ দিন কোন কাজ করতে পারবো না? কোথায় থেকে সংসারে খরচ আসবে, কিভাবে বাসা ভাড়া দিব!কিভাবে আমাদের সন্তানের জন্য নতুন স্কুলের ড্রেজ আর গরুর মাংস কিনবো? বাবা হয়ে ছেলে চাহিদা পূরণ করতে পারেনি? আম্মু বললো আমি প্রয়োজনে জরিদারের বাসাই কাজ করবো? আপনাকে সংসার চলানো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমাদের আকাশ একদিন লেখা-পড়া শিখে মানুষ হবে।তখন আমাদের আর কোন চিন্তা করতে হবে না! আমরা শুরু বসে বসে খাবো। তারপর আমি হাত মুখ ধোঁয়া এসে আব্বুকে বললাম – আব্বু আমার নতুন ড্রেজ আর গরুর মাংস খাওয়া প্রয়োজন নেই! আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়? আমার কথা শুনে আব্বুর দু’চোখ থেকে পানির স্রোত বাহির হতে লাগলো।