ArabicBengaliEnglishHindi

আখেরি চাহার সোম্বা ‘র তাৎপর্য


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২, ৫:৫৪ অপরাহ্ন / ২৭৩
আখেরি চাহার সোম্বা ‘র তাৎপর্য

রসূলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র জীবনের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ আর সমস্ত আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, গতি-বিধি, পদক্ষেপ, সময়-ক্ষণ তথা সমগ্র জীবনই উত্তম আদর্শের অনুপম নিদর্শন। যা কোরআন শরীফে নানা আঙ্গিকে ব্যক্ত হয়েছে। তবে মক্কায় তাঁর নবুওয়্যাত- রেসালত জীবনের ১৩টি বছরই তাঁকে মক্কার কাফের কোরাইশদের নানামুখী কঠোর নির্যাতন নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। হিজরতের পর মদীনায় আগমনের পরও রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদী-মোনাফেকদের নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। মক্কার কাফেররা তাঁকে, মদীনার ইহুদী মোনাফেকদের যোগ সাজশে স্বস্তিতে-শান্তিতে থাকতে দেয়নি এবং তারা সর্বদা আগ্রাসী ষড়যন্ত্র লিপ্ত থাকে এমনকি বহু রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করে এবং সর্বক্ষেত্রেই ওরা শোচনীয় পরাজয় করে। ঐতিহাসিক সত্য এই যে, ওরা মহানবী (সা.) এর প্রাণনাশের পর্যন্ত অপচেষ্টা চালাতে থাকে। মোনাফেক ইহুদী চক্র বিধর্মীরা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারে যে, ইসলামের বিজয়কে প্রতিহত করা সম্ভব নয়।

অবশেষে রসুলুল্লাহ (সা.) এর অসুস্থ হবার খবর ছড়িয়ে পড়লে ইহুদী ও মোনাফেকদের আনন্দের সীমা রইল না, অপর দিকে মুসলমানদের দুঃশ্চিন্তাও বেড়ে যেতে থাকে, তারা দারুণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, হুজুর (সা.) এর চিরবিদায়ের আশঙ্কায় । তাদের চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে হঠাৎ সাময়িকভাবে তিনি আরোগ্য লাভ করার সংবাদে সাহাবায়েকরামের মাঝে যে বিপুল আনন্দ-উল্লাসের সঞ্চার হয়, তা এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

বস্তুত: রোগ-শোক মানব জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপার, এতে মানুষের পরীক্ষা নিহিত থাকে। তবে কিছু কিছু রোগ-পীড়া এমনও আছে, যা কখনও বিস্মৃত হওয়া যায় না। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় নবী হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) এর পীড়া এমন ছিল না যা সহজে বিস্মৃত হওয়া যায়। তিনি পীড়িত হয়ে পড়লে তখনকার মুসলমানগণ কি নিদারুণভাবে উৎকণ্ঠা ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তার বিবরণ ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইন্তেকালের পূর্বে কোন তারিখে তাঁর পীড়ার সূত্রপাত হয়েছিল তা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এ সম্পর্কে ইসলামের বিশ^কোষে বলা হয়েছে : ‘অধিকাংশ বর্ণনানুযায়ী পীড়ার মোট সময় ১৮ সফর বুধবার হতে শুরু করে ১৩ দিন হয়’ (ইবন হিশাম, পৃ. ৯৯৯)।

‘আখেরাী চাহার সোম্বা’ প্রসঙ্গে ইসলামী বিশ^কোষ গ্রন্থে (পৃ.-১১৩) বর্ণিত বিবরণ থেকে ১৮ সফর প্রমাণিত। তবে মহানবী হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) এর পীড়া কোন তারিখ থেকে আরম্ভ হয় তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। উক্ত বিশ^কোষ অনুযায়ী ‘(আখেরী চাহার সোম্বা) আরবি সফর মাসের শেষ বুধবার।’ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মুসলিমগণ এই দিবসটিকে অতি মর্যাদা সহকারে স্মরণ করে থাকেন।

আখেরী চাহার সোম্বা সম্বন্ধে বলা হয় যে, নবী (সা.) এই দিনে তাঁহার পীড়ায় কিছুটা উপশম বোধ করেছিলেন এবং গোসল করেছিলেন। এইদিনের পর আর তিনি গোসল করতে পারেননি। কারণ তৎপর তাঁর পীড়া বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সবশেষে ১২ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন।

রোগের সূচনা ইঙ্গিত বহন করছিল দুনিয়া থেকে হুজুর (সা.) এর চিরবিদায়। আরো জানা যায় যে, হজরত (সা.) এর পীড়া শুরু হয় সফর মাসের বুধবার হতে। কিন্তু পীড়ারকাল এবং ইন্তেকালের তারিখ নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে বর্ণনাগুলো বিভিন্ন। পীড়াকালের যতদিন শক্তি ছিল ততদিন তিনি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়িয়েছেন। এমনও হয়েছে যে, হজরত আলী ও হজরত আব্বাস তাঁকে ধরে ধরে মসজিদে আনতেন। পীড়িতকালে তিনি দুইবার মিম্বরে আরোহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে ইবনে হিশামে বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, ১৯ সফর পীড়ার সূচনা হয়েছিল।

হিজরতের পর মুসলমানদের মোকাবিলা করতে হয় প্রথমে আরবের ইহুদী ও মোশরেকদের বিরুদ্ধে, ৮ম হিজরি সালে নয়া দুশমন দেখা দেয় রোমান খৃষ্টান শক্তি। বসরা ছিল তখন রোমানদের অধীনে। শোরাহবিল ছিলেন বসরার খৃষ্টান শাসনকর্তা। তৎকালে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনেও কোনো দেশের দূতকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ছিল।
মুসলমানদের কাসেদ (দূত) রূপে হজরত হারেস ইবনে ওমায়্য়ার (রা.) শোরাহবিলের কাছে প্রেরিত হয়ে ছিলেন। বসরার খৃষ্টান শাসক কর্তৃক তিনি শহীদ হন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে হিজরি ৮ সালে মূতা অভিযান পরিচালিত হয়। তিন হাজার মুসলিম বাহিনী এক লাখ খৃষ্টান বাহিনীর মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রথমে বহু মুসলমান শহীদ হন, যাদের মধ্যে হযরত জায়দ ইবনে হারেসা (রা.), হযরত জাফর ইবনে আবি তালেব (রা.) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

অবশেষে হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে মূতা যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাগণের শাহাদতের খবরে অত্যন্ত মর্মাহত হন। সিরিয়া সীমান্তে সংঘটিত এই যুদ্ধে বিশিষ্ট সাহাবাগণের শাহাদতের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) ওফাতের পূর্বে উসামা ইবনে জায়দ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন।

লেখকঃ-
এইচ কিউ এম সেলিম আহমদ কাওছার
ইমাম ও খতিব
টিমাইঘর রায়পুর জামে মসজিদ
বিশ্বনাথ, সিলেট।