ArabicBengaliEnglishHindi

কখন উঠবে সূর্য -মোঃ মামুন মোল্যা


প্রকাশের সময় : জুন ২০, ২০২২, ৭:৫০ অপরাহ্ন / ১৬০
কখন উঠবে সূর্য -মোঃ মামুন মোল্যা

গল্প

মা হারানো মেয়ে সুশ্রী। বয়স মাত্র নয় বছর। এখন তার লেখা-পড়া আর খেলাধুলার সময়। সত্য মিথ্যা পৃথক করা এবং কাজ করার বয়স নয়। কিন্তু এই বয়সে প্রধান কাজ ধরা দিয়েছে,থালা বাসন পরিষ্কার

করা,সকাল,দুপুর,সন্ধ্যায় ভাত রাঁধা।কাজ একটু কম হলে মার পিঠে ধরে না।সুশ্রী বড় দুঃখী মেয়ে। সুশ্রীর কোনো বন্ধু বান্ধবীও ছিল না। দিনভর কাজ আর কাজ।
রাত হলে একটু বিশ্রাম নেবার সুযোগ পায়। সুশ্রীর মনে অনেক যন্ত্রণা। কষ্টের কথা কাকে বলবে? তেমন কাউকে কাছে পেতো না। কাছে থাকার মধ্যে পাশের বাড়ির একটি বিড়াল ছিল। বিড়ালটা শুধু তার কাছে আসতো। আর কাছে গিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি আর মুখের দিকে তাকিয়ে ম্যাও ম্যাও করতো। সুশ্রী তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে সে ডাকাডাকি বন্ধ করে দিতো। আর তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। বিড়ালটির তাকানো দেখে সুশ্রী বলে।
তুই বিড়াল হয়ে আমার বেদনা বুঝতে পারিস কিন্তু মানুষ আমার দুঃখ বোঝে না রে ! আমার মা থাকলে ঠিকই আমার দুঃখ বুঝতো। সুশ্রী বিড়ালটিকে বলল তুই আজ থেকে আমার সঙ্গী। তোর নাম আজ থেকে সুখশ্রী। আমার কষ্ট আজ থেকে সব তোকে বলবো,আর তোর মনের কষ্ট সব আমাকে বলবি। সুখশ্রী বলল ঠিক আছে তাই হবে। সুখশ্রী বলল সুশ্রী তোর কষ্টের সব কথা আজ আমাকে খুলে বল। সুশ্রী বলল বাবার কাছে মার কথা আমি জানতে চাইলে আমাকে বলে মা নাকি মামার বাড়ি চলে গেছে। সে নাকি আর আসবে না। আমাকে যে কাজের মেয়েটি ছোট থেকে লালন পালন করে। তার কাছে জানতে চাইলে বলে মা নাকি মামার বাড়ি যাওয়ার পথে হারিয়ে গেছে। সৎ মার কাছেও জানতে চেয়েছি।
তিনি বলেন আমার মা নাকি অনেক আগে মারা গেছে। আমাকে নাকি কাজের মেয়ে লালন পালন করেছে। আর বাবা যখন বাড়ি থাকতো তখন বাবা আমাকে নাকি দেখা শোনা করতো{পাঠক আগে বলছি কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা সেটা বার করার মত বয়স সুশ্রীর হয়নি}। আমার খুব মনে পড়ে। বাবা আমাকে অনেক ভালো বাসতো। অনেক আদর করতো। আমি কষ্ট পেলে আমার বাবার ভীষণ কষ্ট হতো;চোখ বেয়ে জল ঝরতো। আমি হাসলে আমার বাবাও হাসতো। আমার সুখের জন্য বাবা আর একটা বিবাহ করে। আমার বাবার ভালোবাসা পাবার জন্য নতুন মা আমাকে অনেক আদর যত্ন করতো। আমি যা আবদার করতাম তাই পূরণ করতে ভীষণ ব্যাকুল হয়ে যেতো। আমি আমার মা হারানোর শোক ভুলেই গেছিলাম প্রায়। বাবা আমার আনন্দ দেখে খুব আনন্দিত হতো। সৎ মা একদিন তাঁর বাবার বাড়ি

বেড়াতে গেলেন। বাবা আমাকে ডেকে তার কোলে বসিয়ে আমাকে আদর করতে লাগলো। আর বলতে লাগলো মা সুশ্রী আমি ঢাকায় যাবো আগামী জানুয়ারি মাসে। তোমাকে একটা কথা বলছি তুমি তোমার মার কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনবে। আর যদি তোমাকে কোনো কিছু বলে আমি আসলে আমাকে বলবে। আমি এসে তার বিচার করবো। তুমি শুধু লক্ষ্মী মেয়ের মতো মন দিয়ে লেখা-পড়া করবে! তুমি আমাকে কথা দাও? ঠিক আছে বাবা তাই হবে। বাবা ঢাকা চলে গেল।আমার উপর নির্যাতনও শুরু হলো। প্রতিবাদ করতেই বাবার কথা পইপই মনে পড়ে যায়। সুখশ্রী বলল বুঝতে পেরেছি তোর মনের কষ্ট।এখন যা বলি মন দিয়ে শোন। তোর মা মারা যায়নি এবং হারিয়েও যায়নি। তোর বাবা ঠিক বলেছে। তোর মা তোর মামার বাড়ি আছে। তোর মা-বাবা সম্পর্ক করতো। সেটা তোর নানা মেনে নেয়নি। তারপর তারা পালিয়ে বিবাহ করে। তোর বয়স যখন ছয় বছর। তখন তোর নানা ভাই তোর মাকে ফোন দিয়ে বলছিল মা যা হবার হয়েছে এখন আমি সব ভুলে গেছি। তোর মেয়েরে আমারে দেখায় যা। এই কথা শুনে তোর মা বাবা খুব খুশি হয়। তার পর তোর মা বাবা বেড়াতে গেলো। তারপর তোর মাকে রেখে তোর বাবার কাছে তোকে দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে তিন বছর তোর মা তোর নানার বাড়িতে রয়েছে।তোর মা তোর নানার বাড়ি থাকা অবস্থায় দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ চলছে প্রায় ছয় মাস।তোর বাবা একজন সেনাবাহিনী কর্মকর্তা। প্রথম থেকে তোর বাবা একজন গুপ্তচর মুক্তিযুদ্ধা। সেই কথা রাজাকার বাহিনী পাকবাহিনীকে বলে দিলে তোর মাকে ধরতে তোর নানার বাড়ি যায়। পাকবাহিনী তোর মাকে ধরে নিতে চায়। তোর নানা ধরে নিতে বাধা দিলে গুলি করে মেরে ফেলে। তোর মামাও বাধা দিলে তাকেও গুলি করে মেরে

ফেলে। তার পর তোর মাকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এই খবর শুনে তোর বাবা তোর নানার বাড়ি ছুটে যায়। কিন্তু তোর মাকে কোথায় ধরে নিয়ে গেছে সেই সন্ধান পায় না। তারপর তোকে দেখতে এক নজর বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসে দেখে তোকে যে লালন পালন করতো,সেই কাজের মেয়েকেও পাকবাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তারও কোনো খবর নেই। তোকে কে দেখবে? তোকে দেখার জন্য আর একটা বিবাহ করে। তোর সৎ মার কাছে তোকে রেখে আবার তোর বাবা ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যায়। এখন বাংলাদেশ প্রায় স্বাধীনের পথে। সুশ্রী বলল তুই যে এত কিছু বল্লি আমি কি ভাবে বিশ্বাস করবো? শুখশ্রী বলল তুই আমার মালিক রহমতের কাছে গেলে সব জানতে পারবি। কি তুই যাবি? সুশ্রী বলল হ্যাঁ আমি যাবো। সুখশ্রী তাকে সাথে নিয়ে রহমতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সুশ্রী সব খুলে বলল

রহমত বলল হ্যাঁ মা সব সত্যি। আমিও আজ ঢাকা যাবো যুদ্ধ করতে। সুশ্রী বলল মালিক আমাকে সাথে নেবে? রহমত বলল তুমি ছোট্ট মেয়ে সেখানে গিয়ে কি করবে? সুশ্রী বলল মালিক আমি আপনাদের পানি এগিয়ে দেবো। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে চাই। আমি পাকিস্তানের পতন চাই। যারা যুবতী এবং দুধের
বাচ্চার মাকে ধরে ধর্ষণ করে নির্যাতন করে এবং মেরে ফেলে তাদের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা মালিক।আমার মা হারিয়েছি। নানা ভাই,মামাও প্রাণ দিয়েছে
এই মহান মুক্তি যুদ্ধের জন্য। বাবাও হারিয়ে গেছে।এখন যদি আমাকেও হারাতে হয় আমি হারাতে চাই। তবু দেশকে স্বাধীন করতে চাই হারামজাদাদের হাত থেকে। রহমত বলল তোমার মতো সাহসী সন্তান আছে বলে আমরা স্বপ্ন দেখি দেশকে স্বাধীন করার। সুশ্রী আমি তোমাকে অবশ্যই নেবো। রহমত

সুশ্রী কে নিয়ে ঢাকা চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকবাহিনী অত্মসমর্পণ করে। এই ভাবে এক এক করে ঢাকা ,চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, বিভাগ স্বাধীন হয়।

বাকি থাকে শুধু খুলনা বিভাগ। ঢাকা থেকে মুক্তিবাহিনী খুলনা চলে যায়। সেখানে গিলে সুশ্রীর বাবার সাথে দেখা হয়। সুশ্রী তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল বাবা তুমি বেঁচে আছো? বাবা আমার মা কোথায়? হ্যাঁ মা আমি বেঁচে আছি। সুশ্রী আমি যতটুকু জেনেছি তোমার মাকে রাজাকার ধরে পাকবাহিনীর কাছে দিছে। তার পর নাকি তারা ধর্ষণ করে হাত মুখ বেঁধে রূপসা নদীতে ভাসিয়ে দিছে। এই খবর শুনে আমি ঢাকা থেকে খুলনা চলে আসি। যারা তোমার মাকে সহ লক্ষ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম লয় করে মেরেছে তাদের অনেক কে মেরেছি। আর যারা বাকি আছে আজ ওদের আক্রমন করবো সব মুক্তিবাহিনী।

সুশ্রী বলল বাবা আমিও যুদ্ধ করবো। বাবা বলল ঠিক আছে চলো। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে বাবা মেয়ে যুদ্ধ করে। দীর্ঘ দিন যুদ্ধ চললে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় অর্জিত হয়। পাকহানাদার এবং এ দেশীয় দোসরদের হাত থেকে খুলনা অঞ্চলকে মুক্ত করতে অতিরিক্ত আরো একটি দিন মুক্তিকামীদের মরণপণ লড়তে হয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে বাংলার আকাশে। লাল সবুজের কেতন পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় সুশ্রীরা।