নোয়াখালী প্রতিনিধি ->>
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নের গাঙচিলে হতদরিদ্রদের ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে ডিলার রাজীব খাঁনের বিরুদ্ধে।
ডিলার রাজীব খাঁন সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতি ৩০ কেজি চালের উপর ৩০ টাকা করে বেশি নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন অভিযোগ কারীরা।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, চর এলাহী ইউনিয়নের চর কলমি ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিনমজুর মোঃ খোকন মিয়া এ বলেন, ২০১৭ সালে তিনি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক কে বলার পর চেয়ারম্যান তাকে ১০ টাকা দামের একটি চালের কার্ড করে দেন। কার্ড করার পর সে বছর মাত্র একবার চাল পেয়েছেন তিনি। খোকন মিয়া বলেন, ২০১৭ সালে আমার কার্ড হয়েছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আমি ২৫ বার চাল পাওয়ার কথা, কিন্তু আমি চাল পেয়েছি মাত্র ৩ বার। পরবর্তীতে আমি এ বিষয়ে ইউএনও স্যারের কাছে নালিশ করেছিলাম, কিন্তু কোন বিচার পাইনি। বরং এসিল্যান্ড স্যারের কাছে অভিযোগ জানাতে গিয়ে আমরা তার বকাঝোকা শুনেছি।
আরেক অভিযোগ কারী একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, চলতি মাসের ১৭ তারিখে আমি আমার কার্ড নিয়ে ডিলার রাজীবের কাছে যাই চাল আনার জন্য, সে আমাকে এক মাসের চাল দিয়ে আমার কার্ডে দুই মাসের চাল এন্ট্রি করেছে। এছাড়াও সে এর আগে আমার থেকে কার্ডে টিপসই, স্বাক্ষর ও চাল বাবত ৩৩০ টাকা নিয়ে আমাকে চাল দেয়নি। আমি এ বিষয়ে ইউএনও স্যারের নিকট অভিযোগ করেছিলাম, ইউএনও স্যার এসিল্যান্ড স্যারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাদের সাথে কথা বলার জন্য, আমরা ৫ জন এসিল্যান্ডের অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানানোর পর এসিল্যান্ড স্যার উল্টো আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছেন।
গাঙচিল ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিনমজুর জেবল হক বলেন, একবছর আগে কার্ড নবায়নের কথা বলে আমার ছেলে থেকে আমার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছার নামে করা কার্ডটি নিয়ে যায় ডিলার রাজীব খান। পরবর্তীতে সে আর আমাকে কার্ড ফেরত দেয়নি। এখন আমি চালের জন্যে গেলে সে বলে আপনার কার্ড নাই চাল দিবো কিভাবে! আমার ছেলে থেকে কার্ড নেওয়ার কথাও এখন অস্বীকার করছে সে।
গাঙচিল ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আক্তার হোসেন বলেন, আমার বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় একটা কার্ড বানানোর জন্য সবার দ্বারেদ্বারে ঘুরেছেন। একসময় কার্ড বানানোর কথা বলে উনার কাছথেকে আইডি কার্ড ও ছবি সহ সবকিছু নিয়েছিলেন ততকালীন জনপ্রতিনিধি। সবকিছু নেওয়ার পর যখন তিনি জানতে চাইলেন তার কার্ড হয়েছে কি-না, তখন সে জনপ্রতিনিধি বলেছিলেন তার কার্ড হয়নি। অথচ আমার বাবার মৃত্যুর পরে আমরা জানতে পারি আমার বাবার নামে কার্ড আছে। তবে আমাদেরকে কখনো চাল দেয়নি ডিলার রাজীব খান।
চর কলমি ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ চৌধুরী মিয়া অভিযোগ করে বলেন, চালের ডিলার রাজীব খান তার কাছ থেকে তিন বারে ৯৯০ টাকা নিয়েছেন চাল দেওয়ার জন্য, অথচ তাকে চাল দিয়েছেন মাত্র ২ বার। এর আগেও একবার এভাবে টাকা নিয়ে তাকে চাল দেননি বলে জানান তিনি।
৭নং ওয়ার্ডের স্বামী পরিত্যক্তা শিরিন আক্তার বলেন, আমার কার্ডটি আমার স্বামীর নামে করা, আমার স্বামী গত ৪ বছর যাবত আমার কোন খোঁজ খবর নেয় না। আমি আমার চার ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনভাবে দিনাতিপাত করছি। আমি কার্ডটি নিয়ে চাল আনতে গেলে ডিলার রাজীব খান বলে আমার স্বামী নাকি আমাকে চাল দিতে নিষেধ করেছে। তাই সে আমাকে চাল দিবে না। সে চাল দিবে আমার স্বামীর ভাইদেরকে, পরে আমি মেম্বারের কাছে নালিশ দেওয়ার পর সে আমার কার্ড ফেরত দিয়েছে।
গাঙচিল ৯নং ওয়ার্ডের সরকারি আবাসনে বসবাস করা স্বামী পরিত্যক্তা জৈতুন নূর বলেন, ডিলার রাজীব খান, জেলে থাকা অবস্থায় আমি আমার কার্ডটি নবায়নের জন্য দিয়েছিলাম চর এলাহীর আরেক ডিলার মিজানের কাছে। পরে আর কার্ড ফেরত পাইনি। কার্ডের বিষয়ে মিজানকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় কার্ড নাকি রাজীব খানকে দিয়েছে। আমি রাজীব খানের কাছে গেলে রাজীব খান আমাকে ১ হাজার টাকা দিতে বলে। ১ হাজার টাকা দিলে সে আমাকে কার্ড দিবে, নাহলে দিবে না বলে জানায়। কার্ড ছাড়া আমাকে দুইবার চাল দিলেও এখন আর চাল দিচ্ছে না বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ডা. আব্দুল হক টেলিফোনে বলেন, আমার ওয়ার্ডের কয়েকজন লোক এসে আমার কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন ডিলার রাজীব খানের বিরুদ্ধে। পরে আমি আমাদের মহিলা মেম্বার মায়া ধনী সহ রাজীব খানকে জিজ্ঞেস করলে সে সবকিছু অস্বীকার করে। সেসময় ৭নং ওয়ার্ড ও ৯নং ওয়ার্ডের বেশ কয়েকজনকে ও রাজীব খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে দেখা যায়।
৭,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার মায়া ধনীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চালের ডিলার রাজীব খানের বিরুদ্ধে আমার কাছেও কয়েকজন এসে অভিযোগ জানিয়েছেন। সে নাকি মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাল দেয় না, আবার কারো কারো কার্ড ফেরত দেয় না। আমি রাজীব খানকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে তার বিরুদ্ধে করা এসব অভিযোগ সত্য নয়। মায়া ধনী বলেন আমি নিজেও দেখেছি রাজীব খান মানুষের কাছথেকে কার্ড প্রতি ৩৩০ টাকা করে নিয়েছেন, এখন তিনি সেটিও অস্বীকার করছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিলার রাজীব খান এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার বিরুদ্ধে করা একটি অভিযোগও সত্য নয়। আমাকে এলাকার মানুষের কাছে খাটো করতে একটি বিশেষ মহল পায়তারা করছে। আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সমাজের চোখে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে আমার পিছনে উঠেপড়ে লেগেছে। আমি কারো কার্ড আটকিয়ে রাখিনি, সবাইকে তাদের চাল দিচ্ছি সরকার নির্ধারিত ৩০০ টাকা মূল্যে-ই। তাছাড়া আমি যখন চাল দিই তখন সরকারের একজন ট্যাগ অফিসার সামনে উপস্থিত থাকেন, তার সামনে অনিয়ম করার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আমি যদি অনিয়ম করতাম তাহলে অনেক আগেই আমার ডিলারশীপ বাতিল হয়ে যেত।
অনিয়মের বিষয়টি তদন্তের দায়িত্বে থাকা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ আল আমিন এ প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, ইউএনও স্যার আমাকে এ বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমি তদন্ত শেষে ইউএনও স্যারের কাছে রিপোর্ট পেশ করবো। অভিযোগ কারীদের সাথে খারাপ আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কেন উনাদের সাথে খারাপ আচরণ করবো। আমি উনাদের সাথে কোনপ্রকার খারাপ আচরণ করিনি। বরং মনোযোগ সহকারে তাদের সবার অভিযোগ গুলো শুনেছি এবং সেটি নোটে লিপিবদ্ধ করেছি। প্রয়োজনে আপনি আমার অফিসে এসে দেখে যেতে পারেন।
এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ খোরশেদ আলম চৌধুরীকে কল দিলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কিছু অভিযোগ এসেছে ডিলার রাজীব খানের বিরুদ্ধে, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি, তদন্ত শেষে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :