ArabicBengaliEnglishHindi

জামালপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য 


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০২২, ১২:১১ পূর্বাহ্ন / ৩৫২
জামালপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য 
এমরান হোসেন ->>
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী বিধৌত অঞ্চল নামে খ্যাত উত্তরে গারো পাহাড়, দক্ষিণে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের গড়, পূবে ময়মনসিংহ জেলা, পশ্চিমে যমুনা নদী বেষ্টিত সৌন্দর্য্যমন্ডিত লীলা ভূমির নাম জামালপুর জেলা। নবগঠিত ময়মনসিংহ বিভাগের কৃষি প্রধান অঞ্চল ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে যমুনা বিধৌত জামালপুর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি জেলা এবং সবার কাছে পরিচিত। রাজধানী সহ সারাদেশের সঙ্গে রেল, নৌ ও সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে এই জেলা।
প্রায় হাজার বছর পূর্বে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের আড্ডাখানা ছিল। তাই তাদের আড্ডাখানা ও বসতির জন্য প্রথমে জেলার নাম সন্ন্যাসীনগর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৭৫৭ সালের পর ১৮৩৮ ইং সালের তৎকালীণ বৃটিশ সরকার এ অঞ্চলে রেল যোগাযোগ চালু করে। সে সময় রেলওয়ে স্টেশনের নামকরণ করা হয় সিংহজানী রেলওয়ে জংশন। বর্তমানে জামালপুর টাউন জংশন নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
জামালপুর জেলায় ১২০১ থেকে ১৫০৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল ইয়েমেন থেকে বেশ ক’জন প্রখ্যাত অলির আগমন ঘটেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম হযরত শাহ সুফি সৈয়্যদ শাহ জামাল (রঃ) । তিনি একাধারে ইসলাম প্রচারের মধ্য দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত করেন। তার জবনিকা ঘটলে জামালপুর সদর থানার সন্নিকটে তাকে সমাহিত করা হয়। যা এখন হযরত শাহ জামাল (রঃ) রওজা শরীফ। পর্যায়ক্রমে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বলিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে সন্ন্যাসীনগর কিংবা সিংহজানী নাম পরিবর্তন করে প্রখ্যাত অলির নামে এই জেলার নামকরণ করা হয় জামালপুর।
জেলার উত্তর দিকে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা, ভারতের মেঘালয় রাজ্য এবং গারো পাহাড়। পূর্ব দিকে শেরপুর ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা। পশ্চিম দিকে যমুনা নদী এবং সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলা। দক্ষিণ দিকে টাঙ্গাইল জেলা।
জেলার মোট আয়তন ২০৩১.৯৮ বর্গ কিলোমিটার।৭৮৪ বর্গমাইলের জামালপুর জেলার জনসংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। জেলার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০.৫৮ ভাগ পুরুষ এবং ৪৯.৪২ ভাগ মহিলা। এই জেলার শতকরা ৯৭.৭৪ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বাকি ২.২৬ ভাগ মানুষ হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। উপজাতি গোষ্ঠীদের মধ্যে গারো অন্যতম। তারা শেরপুর ও জামালপুরের গারো ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন। এছাড়াও হদি, কুর্মী এবং মাল এই জেলার অন্যতম উপজাতি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জামালপুর জেলা ১১নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর বৃহত্তর টাঙ্গাইল জেলা থেকে পৃথক করে জামালপুর কে আলাদা জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।জামালপুর সদর, মেলান্দহ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও সরিষাবাড়ি এই ৭টি উপজেলার সমন্বয়ে জামালপুর জেলা গঠিত। প্রতিটি উপজেলার সাথেই রয়েছে ভালো সড়ক যোগাযোগ সহ সদরের সাথে ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ ও সরিষাবাড়ি উপজেলার রয়েছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।
বিভিন্ন বিখ্যাত জিনিসের জন্য জামালপুর জেলার খ্যাতি দেশজুড়েই। এরমধ্যে দেওয়ানগঞ্জের জিল বাংলা সুগার মিলে উৎপাদিত চিনি, মেলান্দহে উৎপন্ন উন্নত মানের তামাক এবং তৈল। সদর উপজেলার বিখ্যাত বুড়িমার মিষ্টি, ছানার পায়েস এবং ছানার মিষ্টি ছাড়াও আনারস ও পান। মাদারগঞ্জ উপজেলায় উৎপন্ন মাছ, দুধ ও সুস্বাদু ঘি। বকশীগঞ্জের নকশীকাঁথা। সরিষাবাড়ি উপজেলাতে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী যমুনা সার কারখানা। এছাড়াও এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে সোনালী আঁশ পাট, মরিচ, ধান ও শাকসবজি উৎপন্ন হয়।
জামালপুরের ইসলামপুরে প্রাচীনকালে গড়ে উঠা কাসার শিল্প সারাদেশেই বিখ্যাত। কাসার তৈরি আসবাবপত্র যেমন বাটি, প্লেট, জগ, গ্লাস, হুক্কা, বদনা এবং খেলনা সামগ্রী উল্লেখযোগ্য। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার বঁধুরা স্বভাবগতভাবেই গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য্য, সংস্কৃতিকে সুই সুতোর মাধ্যমে তাদের তৈরি কাথায় ফুটিয়ে তুলে আসছেন। তবে এই বিষয়টাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন জামালপুরের বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দহ অঞ্চলের বঁধুগন। এখন বাণিজ্যিকভাবে নকশীকাঁথা তৈরি করা হচ্ছে। যা জেলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জেলার শিল্প সমূহের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প। মাটির তৈরি আসবাপত্র, হাড়ি পাতিল, খেলনা, গৃহসজ্জার জিনিসপত্র এখন দেশ বিদেশে অনেক জনপ্রিয়।
জামালপুর জেলা পূর্বে সকল ধরণের সুযোগ সুবিধায় পিছিয়ে থাকায় তেমন শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। তবে বিগত দুই দশক থেকে এই জেলায় শিক্ষার হার বৃদ্ধি খুবই চমকপ্রদ। বর্তমানে এই জেলার শতকরা শিক্ষার হার প্রায় ৪০ শতাংশ।জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহের মধ্যে ১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়–শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও ১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া শেখ রাসেল টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শেখ হাসিনা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি রয়েছে। যা জেলার শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও ৮টি সরকারি কলেজ, ২০টি বেসরকারি কলেজ, ৭টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহ মোট ২৩১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১১০ টি মাদ্রাসা, ৩৮টি জুনিয়র হাইস্কুল, ৫৮৮ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৯০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৭৬টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল, ১টি হোমিওপ্যাথিক কলেজ, ১টি আইন কলেজ ও ১টি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিগণের মধ্যে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ, বীর বিক্রম শহীদ শাহজাহান, শহীদ আমানুল্লাহ কবির প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। যাদের অসামান্য অবদান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে অর্জন করেছি স্বাধীনতা।
এছাড়াও কবি ও সাহিত্যিক হারুন হাবিব, হাসান হাফিজুর রহমান।বাংলা চলচিত্রের প্রখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, আমজাদ হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, প্রখ্যাত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, রাজনীতিবিদ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, মৌলভী আব্দুল জব্বার পাহলোয়ান, ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার, রাশেদ মোশারফ, রেজাউল করিম হীরা, আবুল কালাম আজাদ, মির্জা আজম, আব্দুল কাইয়ুম উল্লেখযোগ্য।
জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে হযরত শাহ জামালের মাজার, হযরত শাহ কামালের মাজার, যমুনা সার কারখানা, জিল বাংলা সুগার মিল, গারো পাহাড়, লাউচাপড়া, মধুটিলা ইকো পার্ক, যমুনা নদীর তীর অন্যতম। এছাড়াও সদরের দয়াময়ী মন্দির, হরিশ চন্দ্রের দীঘি, গান্ধী আশ্রম, লুইস ভিলেজ পার্ক, যমুনা সিটি পার্ক, বাহাদুরাবাদ ঘাট, হাওয়াই রোড, খরকা বিল দর্শন করার জন্য উল্লেখযোগ্য ।