ArabicBengaliEnglishHindi

দেশজুরে বাড়ছে মাদকের ব্যবহার


প্রকাশের সময় : জুলাই ১৬, ২০২২, ৯:১৪ অপরাহ্ন / ৭৫
দেশজুরে বাড়ছে মাদকের ব্যবহার

বিশেষ প্রতিনিধি ->>
নেশার টাকা জোগাড় করতে মাত্র ২০ হাজার টাকায় দেড় বছরের শিশু সন্তানকে বিক্রি করেন এক মাদকাসক্ত বাবা। গত ৮ জুন চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় এ ঘটনার পর পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়। পুলিশ জানায়, মতলব দক্ষিণ উপজেলার বাবুপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইমরান পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। টাকার জন্য তিনি সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার পর শিশুর মা লামিয়া আক্তার থানা পুলিশের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ জানান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মতলব উত্তর উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। ইমরান হোসেনের স্ত্রী লামিয়া আক্তার দাবি করেন, মূলত মাদকের টাকার জন্যই তাদের শিশুসন্তান অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে স্বামী।

গত ২৩ মে রাজশাহীতে নেশার টাকার জন্য ছিনতাই করে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এক চাকরিজীবী। ৩৬ বছর বয়সী আব্দুল ওয়াদুদ বুলবুল নামের ওই ব্যক্তি সচ্ছল পরিবারের সন্তান। বাণিজ্যে স্নাতক পাস করে একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি করেন। রয়েছে স্ত্রী-সন্তান; কিন্তু মাদকের নেশায় তিনি এখন ভয়ংকর ছিনতাইকারী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের স্ত্রীর ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। নেশার টাকা সংগ্রহ করতেই ছিনতাই করেন বলে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন ওয়াদুদ। তার বাড়ি নগরীর নওদাপাড়া এলাকায়। ওয়াদুদের বাবা আব্দুল হামিদ গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ছিলেন। তাদের চারতলা বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে বাস করেন ওয়াদুদ।

পুলিশ জানায়, ওয়াদুদ ভয়ংকর ছিনতাইকারী। তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, শখ করে এক বন্ধুর সঙ্গে একদিন ফেনসিডিল সেবন করেন। এরপর ইয়াবা ট্যাবলেট। তারপর চেষ্টা করেও আর এসব ছাড়তে পারেননি। মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে টাকা সংগ্রহ করতেই তিনি ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ জগতে পা বাড়িয়েছেন।

পুলিশ জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক শাতিল সিরাজের স্ত্রী ইফফাত জাহানের ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাই হয়। থানায় অভিযোগ হলে ঘটনার পরদিন রাতে ওয়াদুদকে গ্রেপ্তার করে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ। ইফফাত জাহান রিকশায় চড়ে নগরীর রেলগেট থেকে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিলেন। তখনই মোটরসাইকেল নিয়ে ইফফাতের ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যান ওয়াদুদ। পরে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাকে শনাক্ত করা হয়। পরে লক্ষ্মীপুর মোড় থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকালে ছিনতাইয়ের কথা স্বীকার করেন ওয়াদুদ। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ছিনতাই করা ব্যাগ ও টাকা। তবে ইফফাতের মুঠোফোনটি পাওয়া যায়নি। ছিনতাই করা মুঠোফোনটি তিনি ড্রেনে ফেলে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এর আগেও তিনি এভাবে ছিনতাই করেছেন।

বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, মাদকের নেশার টাকা সংগ্রহের জন্য অনেক সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তানরাও ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।

শুধু এক ওয়াদুদ বা ইমরান নয়, প্রায় প্রতিদিনই মাদকের টাকার জন্য কেউ হয়ে উঠছেন ছিনতাইকারী, কেউবা খুনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বাৎসরিক রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রতি বছরই দেশে মাদকের অপব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইয়াবার ব্যবহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২৬ জুন মাদকদ্রব্য জব্দের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, দেশে হেরোইনের অপব্যবহার বেড়েছে। গাঁজার অপব্যবহার ২০১৪-১৭ সাল পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান থাকলেও ২০১৮ সাল থেকে গাঁজার অপব্যবহার কিছুটা কমেছে। ফেনসিডিল ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে কিছুটা কমলেও ২০১৭ সালে তা আবারও বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে স্থিতিশীল ছিল। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ইনজেক্টিং ড্রাগের অপব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে কমে ১৭ সালে আবারো বাড়ে।

২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, বিজিবি, র্যা ব ও কোস্টগার্ড মিলে জব্দ মাদকের পরিমাণে দেখা যায়- ২০১৪ সালে কোকেন ২.০৮৫ কেজি, ফেনসিডিল ৭৪১১৩৭ বোতল ও ৪৩৮.২১৮ লিটার, হেরোইন ৭৮.৩০৩ কেজি, বিদেশি মদ ২৯৩২৫৪ বোতল, গাঁজা, ৩৫৯৮৮.৫৬ কেজি, ইনজেকটিং ড্রাগ ১৭, ৮৮৯ পিস, ইয়াবা ৬৫,১২,৮৬৯ পিস জব্দ করে। ২০১৫ সালে কোকেন ৫.৭৭৮ কেজি, ফেনসিডিল ৮৭০২১০ বোতল ও ৫১০৪.৭৫ লিটার, হেরোইন ১০৭.৫৩৯ কেজি, বিদেশি মদ ৩২২৫৮৯ বোতল, গাঁজা, ৩৯৯৬৭.৫৯ কেজি, ইনজেকটিং ড্রাগ ৮৫, ৯৪৬ পিস, ইয়াবা ২,০১,৭৭,৫৮১ পিস জব্দ করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে- ভারত থেকে ২৩ রুটে, মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানের ১৫টি রুট ব্যবহার করে দেশে মাদক ঢুকছে। ২৬ জুন ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাদক চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশের অনুরোধে সীমান্তের আশাপাশের ফেনসিডিল কারখানা এরই মধ্যে ধংস করেছে ভারত। তবে এখনো যেসব কারখানা আছে সেগুলো ধীরে ধীরে ধংস করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভয়ংকর যেসব মাদক আসছে, সেগুলো রোধে ভারতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। আমরা তাদের সব সময় অনুরোধ করছি এবং আমাদের অনুরোধে তারা ফেনসিডিল কারখানা সরিয়ে নিয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমার, যেখান থেকে ভয়ংকর মাদকগুলো আসে। সেই ড্রাগগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা সর্বত্মক প্রচেষ্টা নিয়েছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, আমাদের ডিজি তাদের ডিজির আলাপ হচ্ছে, আমরা তাদের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। মিয়ানমারকে যখন আমরা অবহিত করি তখন তারা বুঝেন, পরে আর কিছু করেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এ কারণে আমরা সীমান্তে বিজিবিকে শক্তিশালী করছি, আমাদের কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করছি। এই মাদক যাতে দেশে না ঢুকতে পারে সেদিকে নজরদারি করছি। আমরা সীমান্ত এলাকায় সেন্সর বসানোর ব্যবস্থা করছি, যাতে কেউ আসলে বা গেলে তার অস্তিত্ব আমরা টের পাই।

মাদকের চোরাচালান ও অপব্যবহার বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত সব দেশই আজ এ সমস্যায় আক্রান্ত। আমাদের দেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের প্রধান দুটি মাদক উৎপাদনকারী বলয়ে অবস্থিত হওয়ায় এটি মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এতে দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষ করে যুব সমাজের একটি অংশ মেধা ও কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সারা বিশ্বে যেভাবে কাজ করে, আমরাও ঠিক সেভাবে কাজ করি। সাপ্লাই হ্রাস, ডিমান্ড হ্রাস ও হার্ম হ্রাস এই তিন পদ্ধতিতে আমরা কাজ করে থাকি।

মাদক যখন কেউ গ্রহণ করা শুরু করে দেয়, সেটা থাকে কৌতূহলবসত উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রথমে তারা সিগারেটে এক-দুই টান দেয়। এক দুই টান দিতে দিতেই কোস দিন যে চেইন স্মোকার হয়ে যায় সেটা তার অজান্তেই হয়ে যায়। তার পর শুরু করে দুই এক ছিলিম গাঁজা দিয়ে। তার পরে সে যে উল্কার মতো চলে, সে নিজেও বুঝতে পারে না। আমরা হার্ম হ্রাসের জন্য এই সমস্ত ড্রাগ অ্যাডিক্টেডদের খুঁজে বেড়াই। আমাদের কাছে যে পরিসংখ্যান রয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। কারো কারো পরিসংখ্যানে আরো বেশি। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ আবার যৌন অপরাধী। জেলখানায় যত মানুষ আছে, এর বেশিরভাগই মাদক পাচারকারী কিংবা কারবারি। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মাদকসেবীদের ৮০ শতাংশই যুবক। আমরা সরকারিভাবে বলেছিলাম প্রকাশ্যে কেউ ধূমপান করতে পারবে না। এখনো কিন্তু একটা মেনে চলছে। সমীক্ষা বলছে, ৮ শতাংশ ধূমপায়ী কমেছে কিন্তু আমার মনে হয় আরো কমেছে। সবাই মিলে কাজ করলে আমরা এখান থেকে পরিত্রাণ হতে পারব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশকে মাদকাসক্ত মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতিকে সামনে রেখে আমরা কাজ করছি। পুলিশ, বিজিবি, র্যা ব, কোস্টগার্ড, আনসার ও ভিডিপির পাশাপাশি নোডাল এজেন্সি হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।