ArabicBengaliEnglishHindi

নিরাপদ অভয়াশ্রম বৃদ্ধির দাবি-হাকালুকিতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পরিযায়ী পাখি


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ২০, ২০২২, ৫:০১ অপরাহ্ন / ৩৯০
নিরাপদ অভয়াশ্রম বৃদ্ধির দাবি-হাকালুকিতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পরিযায়ী পাখি
মারুফ আহমেদ  (মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি) :
মিটা পানির জলাভূমি নামে খ্যাত এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইসিএ আওতাভুক্ত কোন প্রকল্প না থাকা ও পর্যাপ্ত নিরাপদ অভয়াশ্রম না থাকাসহ নানা কারণে প্রতিবেশগত সংকাটপন্ন এ হাওরে পাখি কমেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাখির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারো অতিথি পাখির সংখ্যা কমেছে। গত বছর ২০২১ সালে ৪৫ প্রজাতির মোট ২৪ হাজার ৫৫১টি জলচর পাখি দেখা গেছে, ২০২০ সালে ৫৩ প্রজাতির ৪০ হাজার ১২৬টি, ২০১৯ সালে ৫১ প্রজাতির ৩৭ হাজার ৯৩১টি, ২০১৮ সালে ৪৪ প্রজাতির ৪৫ হাজার ১০০ এবং ২০১৭ সালে ৫০ প্রজাতির ৫৮ হাজার ২৮১ টি পাখির দেখা মেলে।

সরকারি অর্থায়নে গত ১৬ ও ১৭ ফেব্রæয়ারি হাকালুকিতে অনুষ্ঠিত দুই দিনের পাখিশুমারি শেষে শুমারী দলের প্রধান পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে এ বছর পাখির সংখ্যা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বলেন, শুমারির কাজ শেষ করে পাখির সম্পূর্ণ তথ্য আইইউসিএন এর কাছে জমা দেয়া হয়েছে। পাখির তথ্য আমাদের কাছে আছে, কিন্তু আমরা সেটা দিতে পারিনা। যেহেতু প্রথমবারের মতো সরকারি অর্থায়নে শুমারিটি হয়েছে। সেহেতু সরকারি একটি প্রক্রিয়ায় বিষয়টি যাবে। পাখির সংখ্যার বিষয়ে তথ্য দিবে আইইউসিএন ও বনবিভাগ।

শুমারিকালে হাকালুকি হাওরের ৪৫টি বিলে গত বছরের চেয়েও অনেকটা কম পাখির দেখা মিলেছে। হাওরের কুলাউড়া অংশের চকিয়া বিলে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৬০০টি শামুকখোল পাখির দেখা মিলেছে। এর আগে সর্বোচ্চ তিন হাজার শামুকখোল পাখি এই বিলে দেখা গিয়েছিল। এছাড়া হাওরখাল বিলে তিনটি বিপন্ন প্রজাতির কালা-গলা-মানিকজোড় প্রজাতির পাখির বাচ্চা দেখা গেছে। যেকোন পাখির নতুন বাচ্চা খাবারের সন্ধানে নতুন নতুন জায়গায় চলে যায় কারণ তারা যদি একই স্থানে তাকে তাহলে তারা খাদ্যসংকটে ভুগবে। হাওরের নাগুয়া বিলে চকাচকি প্রজাতির একটি পাখি মৃত দেখা গেছে। সেই মৃত পাখির ওপর একই প্রজাতির ৪টি চকাচকি পাখি উড়াউড়ি করছে যা খুবই দুঃখজনক।

বনবিভাগের সুফল প্রকল্পের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন (পিওজেএফ) যৌথ উদ্যোগে এবারের শুমারির আয়োজন করে। সহযোগতিায় ছিল বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব (বিবিসি)। পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হকের নেতৃত্বে এ শুমারি পরিচালনা করা হয়। শুমারিতে অংশ নেন বার্ড ক্লাবের সদস্য অণু তারেক, শফিকুর রহমান, আইইউসিএন ও বার্ড ক্লাবের সদস্য জেনিফার আজমেরি, সাকিব আহমেদ।

জানা গেছে, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে হাকালুকি হাওরটি বিস্তৃত। এটি দেশের বৃহত্তম হাওর। ১৬ ফেব্রæয়ারি সকাল থেকে ৬ সদস্যের দুটি দল দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে হাওরের ছোট-বড় ৪৫টি বিলে শুমারি কাজ শুরু করে ১৭ ফেব্রæয়ারিও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শুমারির কাজ চলে।

এদিকে হাকালুকি হাওরটি কোন উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় অরক্ষিত হাওরে বিষটোপ আর ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করায় দিন দিন অতিথি পাখির সমাগম কমছে। মৎস্য অভয়াশ্রম থাকলেও সেই অভয়াশ্রমগুলোতে শিকারিরা হানা দেয়। শীতকালে এসব বিলকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা হাওরাঞ্চল। হাওরের ইকো সিস্টেম রক্ষায় অবিলম্বে হাওরকে উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি হাওর তীরের মানুষের। ১৯৯৯ সালে সরকার এ হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা ইসিএ) ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে এর কোন কার্যত উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

কুলাউড়ার পরিবেশ কর্মী এস আলম সুমন বলেন, হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গঠিত ইসিএ কমিটির কর্মীদের কার্যক্রম গত ৫ বছর ধরে তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে করে হাওরের হিজল করচ বন অবাধে উজাড় করছে একটি চক্র। পরিযায়ী পাখি বিষটোপ ফেলে অবাধে নিধন করা হচ্ছে। এছাড়াও হাওরের কৃষি জমিতে বোরো আবাধে রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে জমিতে খাবার সংগ্রহের সময় রাসায়নিক সারযুক্ত খাবার খেয়ে পাখি মারা যায়। পরিযায়ী পাখিরা যেখানে তাদের জীবন বিপন্ন মনে করে সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাই পাখিদের জন্য নিরাপদ অভয়াশ্রম বৃদ্ধি করতে হবে। হাওরে ইসিএ আওতাভুক্ত প্রকল্পগ্রহণ করে সেগুলোর কার্যক্রম সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ তদারিক করলে হাওরের জীববৈচিত্র্য কিছুটা রক্ষা হবে।

মৌলভীবাজার জেলা সাংবাদিক ফোরামের সহ-সভাপতি, এম. মছব্বির আলী বলেন, একসময় এই হাকালুকিতে লক্ষ লক্ষ পাখির সমাগতম ঘটতো। কিন্তু বর্তমানে যত সময় যাচ্ছে ততই পাখির সংখ্যা কমছে। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, হাওরটি বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তাছাড়া এই হাওরে অবাধে বিষটোপে পাখি নিধনের ধ্বংসযজ্ঞ চলে। শুমারি শুনে আশা করে হাওরে পাখি দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু আশানুরুপ কোন পাখির সন্ধান দেখতে পাইনি।

পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ইনাম আল হক বলেন, হাওরের অধিকাংশ বিলে এবার পানি কমে গেছে, তাই পাখির সংখ্যাটাও স্বাভাবিকভাবে কমেছে। ভারত থেকে উৎপত্তি বিভিন্ন নদী থেকে পলি মাটি জমে হাওরের জমি-জলাশয় ভরাট হচ্ছে। এতে হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া এবার শুমারি করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। যেসব পাখি গভীর পানিতে থাকে, সেগুলোকে এবার দেখা যায়নি। শুধু কম পানিতে থাকা পাখির দেখা মিলেছে।

তিনি আরো বলেন, শীত মৌসুমে দুবৃত্তরা হাওরে বিষটোপ দিয়ে পাখি নিধন করতো। বিষটোপের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি পাখি মারা যায়। পাখিরা তাদের জীবন বিপন্ন মনে করলে আর ওই হাওরে ভিড় করে না। তিনি মনে করেন, পাখি শিকারিদের অবাধ নিধনযজ্ঞে হাওরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি হুমকীর মুখে আছে। পাখির সংখ্যা বাড়াতে হলে বিষটোপে শিকার বন্ধ করতে হবে এবং নিরাপদ অভয়াশ্রম করে তা সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য বছরগুলোতে তারা ফেব্রæয়ারির প্রথম দিকে হাকালুকিতে পাখি শুমারি করতেন। আগামীতে প্রতিবছর জানুয়ারির শুরুর দিকে পাখি শুমারি করলে পাখির সংখ্যা বেশি পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ করেন পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক।