বিশেষ প্রতিনিধি ->>
বেকায়দায় পড়েছে দেশের তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কারণে ওই সঙ্কট আরো প্রকট হয়েছে। কারণ বিপিডিবি এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) সমস্যার কথা জানিয়ে ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। মূলত ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ছে।
পাশাপাশি ডলার সংকট বাংলাদেশের জ¦ালানি ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে তেল আমদানি করতে পারছে না। বিশ্ববাজারে জালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং বিপিডিবি বিল পরিশোধে বিলম্ব করায় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জ¦ালানি তেল এইচএফওর বিল পরিশোধ করতে পারছে না। সংকট উত্তরণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুকূলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লিমিট বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে ওই পদক্ষেপ নেয় তার জন্য বিআইপিপিএ’র পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বিপিডিপিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলমান সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট ছোট বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো। কারণ ওসব কোম্পানির পক্ষে একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সংকট সামাল দেয়া সম্ভব। সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তা কোম্পানিগুলোর আর্থিক সক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আর বিদ্যুৎ কেনাবেচার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে বিপিডিবি প্রতি বছরই আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ছে। বিদ্যুৎ বিক্রিতে প্রতি মাসে ঘাটতি থাকায় সংস্থাটিকে সরকারের কাছ থেকে বড় অংকের সহায়তা নিতে হয়। আর ওই অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ বিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বিল বিলম্ব ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লিমিট বাড়ানোর বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে এখনো বিপিডিবি কোনো সদুত্তর পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে ক্রয়মূল্যের চেয়ে কমে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় বেড়েই চলেছে বিপিডিবির দেনা। সরকারের কাছে সংস্থাটির দেনা ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের শুধু দুই মাসের হিসেবেই বিদ্যুৎ ক্রয় ও বিক্রিতে বিপিডিবির ট্যারিফ ঘাটতি ৪ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এ টাকা সংস্থাটি ভর্তুকি হিসেবে অর্থ বিভাগের কাছে চেয়েছিল। ওসব দায়দেনা সামলাতে না পেরে ইতোমধ্যে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে সংস্থাটি প্রস্তাব দিয়েছে এবং ওই। সে প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিও হয়েছে। তবে দাম বাড়বে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাপী জালানি পণ্যের দাম বাড়ার কারণে টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে আমদানিকারক দেশগুলো। বাংলাদেশও ওই অবস্থার শিকার। বিশেষ করে ডলার সংকটের কারণে তেল আমদানিতে বিপিসি বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। যার প্রভাব দেশের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে পড়ছে। কারণ দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জালানি হিসেবে যে তেল ব্যবহৃত হয় তা বিপিসির মাধ্যমে বিপিডিবি আমদানি করে। তারপর তা সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু জালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহ সংকটের কারণে ইতোমধ্যে দেশের বেশকিছু তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন সংকটে পড়েছে। ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান পরিস্থিতি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো গত দেড় মাস আগে বিপিডিবিকে চিঠিও দিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জালানি সরবরাহে এবং কেন্দ্র চালু রাখার বিষয় জানিয়ে বিপিডিবিকে চিঠি দিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ার। চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় স্থাপিত ৩০০ মেগাওয়াট, পটুয়াখালীতে ১৫০ মেগাওয়াট, জামালপুরে ১১৫ ও ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ¦ালানি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) ইস্যু এবং প্রসেস করতে অসমর্থ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎ উৎপাদন সংকটে পড়ে। ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জ¦ালানি তেল এইচএফও সরবরাহের জন্য বিপিডিবির পক্ষ থেকে বিপিসিকে অনুরোধ করা হয়। ওই চিঠিতেই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির অনুরোধ অনুযায়ী ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লিমিট বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হয়। তবে ওই চিঠির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।
এদিকে গত ১৮ মে বিআইপিপিএ’র পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ, জালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগকে চিঠি পাঠানো হয়। ওই প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। তবে ওই চিঠির বিষয়ে এখনো কোনো উত্তর দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিআইপিপিএ চিঠি পাঠানোর পর দেড় মাস পেরোলেও এখনো সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিআইপিপিএর সভাপতি ইমরান করিম জানান, জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট এবং বিলসংক্রান্ত বিষয়টি আমরা বিদ্যুৎ বিভাগকে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অর্থ বিভাগের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। যেহেতু বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, ওই কারণে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-সচিব সাইফুল ইসলাম আজাদ (উন্নয়ন-১) জানান, আইপিপির চিঠির বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো কিছু জানায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :