ArabicBengaliEnglishHindi

লামা পাহাড়ে রাবার বাগানের নামে চলছে আরেক ষড়যন্ত্র!


প্রকাশের সময় : মে ১৪, ২০২২, ৩:১১ অপরাহ্ন / ৫৮
লামা পাহাড়ে রাবার বাগানের নামে চলছে আরেক ষড়যন্ত্র!

সাইদুর রহমান রিমন ->>
বান্দরবানের লামা পাহাড়ি এলাকায় ব্যক্তি মালিকানায় রাবার বাগানের নামে আরেক ষড়যন্ত্র চলছে না তো! যে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাহাড়ের বিরাজমান শান্তি বিনষ্ট হতে পারে। যে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাহাড়িদের বাস্তুভিটা ও চাষাবাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার পাঁয়তারা হচ্ছে। পারস্পারিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের প্রতি অসন্তোষ তৈরির অপকৌশল কি না তা ভালভাবে পরখ করে দেখা উচিত ……

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড যে একটা গাছ আর একটা খুঁটি সম্বল করে একটি ব্যানার টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল সেখানে লেখা ছিল ‘জেলা প্রশাসক বান্দরবান থেকে লীজকৃত দলিল-মূলে মালিক’। অনেকগুলো প্রশ্ন চলে আসে। আসলেই কি বান্দরবানের ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক ইজারাকৃত এই জায়গা? নাকি নাম ভাংগিয়ে জোর জুলুমের জায়েজ করা? যদি ডিসি কর্তৃক ইজারাই প্রদান করা হয়ে থাকে, তাহলে জুমভূমি, আদিবাসীদের প্রথাগতভাবে ব্যবহৃত ভূমি ইজারার আওতায় কিভাবে পড়ে, কোন আইনের আওতায় পড়ে?

জুমভূমি কেড়ে নেয়া, পানির উৎস ধ্বংস করা, বন প্রকৃতি ধ্বংস করে আদিবাসীদের আবাস্থল বসবাসের অনুপোযোগী করা আর জীবনাচার ধ্বংস করা- এসকল কর্মকান্ডই আদিবাসীদের তাদের লোকালয় থেকে উচ্ছেদ করার সামিল। জুমভূমি তাদের ভূমি, তাদের টেরিটোরির অংশ। বাংলাদেশ সরকার যে আইএলও কনভেনশন, ১০৭ এ অনুস্বাক্ষর করেছে, সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে সরকার আদিবাসী এবং ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত ভূমি, যেখানে তারা প্রথাগতভাবে ব্যবহার করে আসছে, সেটির মালিকানার স্বীকৃতি প্রদান করবে। আরেকটি অনুচ্ছেদে লেখা আছে যে সেই জনগোষ্ঠীকে তাদের এলাকা থেকে সরকার উচ্ছেদ করবে না যদি না জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ, জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থ অথবা সেই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থ সেখানে জড়িত থাকে। প্রশ্ন থাকে, এই তিন শর্তের মধ্যে কোন শর্তের আওতায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ইজারা প্রদান করা যায়।

আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এর অনুচ্ছেদগুলো আরও নির্দিষ্ট, আরও সুরক্ষিত যদিও সরকার এখনো অনুস্বাক্ষর করেনি এই কনভেনশনে। জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমি, টেরিটোরি এবং তন্মধ্যে অবস্থিত সম্পদের উপর তাদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের এলাকায় যাই করা হোক সে ভাল হোক বা মন্দ হোক, তাদের সাথে আলোচনার সাপেক্ষে, তাদের অবহিত করে, তাদের পর্যালোচনার জন্য যথেষ্ঠ সময় দিয়ে, জোর জবরদস্তি, হুমকি প্রদান বা কোনরকমের প্ররোচনায় প্ররোচিত না করে তাদের সম্মতি নিয়ে করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা আছে। লামার সরইয়ে আদিবাসীদের এলাকায় তাদের কিছু না জানিয়ে তাদের সম্মতি ছাড়াই তাদের ভূমি ইজারা দেয়ার মাধ্যমে আদিবাসীদের এই সর্বজন স্বীকৃত আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার হরণ করা হয়েছে।

বান্দরবানের বর্তমান ডেপুটি কমিশনার মহোদয়ার সুনামই শুনেছি এতদিন। উনি এই ইজারার আদ্যোপান্ত পুরো বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল কিনা, তা জানা অবশ্য জরুরি। তিনি না জেনে থাকলে তাকে পুরো বিষয় খতিয়ে দেখার আহ্বান করা উচিত। একইসাথে তার কাছে এই ইজারা বাতিলের জন্য দাবী উত্থাপন করা দরকার যেন ভবিষ্যতে অন্তত এই এলাকার মানুষের একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে না হয় এবং অন্যত্র এলাকার মানুষদের একই ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে না হয়।

আরেকটি ব্যাপার। ত্রাণ আর ক্ষতিপূরণ যেন আমরা গুলিয়ে না ফেলি। যে যে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কারণে তিনটি পাড়ার দরিদ্র মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে এখন হতদরিদ্রেরও তলার কোঠায় পৌঁছে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে ত্রাণ চাওয়া মানে ভক্ষককে রক্ষকের মর্যাদা দেয়া। পেটে ক্ষুধা নিয়ে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়েও যে এই তিন পাড়ার মানুষ ‘ত্রাণ’ ফিরিয়ে দিয়েছেন, ভক্ষককে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন, সেখান থেকে আমাদের শেখার আছে। গাইবান্ধার সাঁওতালরা যে ২০১৬ সালে ভক্ষকদের ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, সেসময় সেখান থেকে যদি শিখে থাকতে না পারি, তাহলে শেখার আরেকটি সুযোগ আমাদের দেয়া হয়েছে, লামার এই মানুষেরা আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।

এই আমাদের, যারা প্রতিনিয়ত আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে এই বর্জ্য-সর্বস্ব সমাজে মাথা উঁচু করে হাঁটার পথ তৈরি করাকে আমরা একপ্রকার রীতি বানিয়ে নিয়েছি, তাদের, আমাদের সকলের।
যার বা যাদের কারণে এই ক্ষতির শিকার হলেন পাড়াবাসী, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাইতে হবে সে হোক লামা রাবার কোম্পানি বা জেলা প্রশাসন। ন্যায্য ক্ষতিপূরণ। ত্রাণ নয়। ক্ষতিপূরণের জন্য দাবী তোলা এবং তা আদায় করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তবে সরকার বা প্রশাসন যদি ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে পারে, আশ্বাস নয় কিন্তু, নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে মধ্যবর্তী সময়ে সরকারি সহায়তা যেটি বিনা শর্ত স্বাপেক্ষে প্রদান করা হবে সেটি গ্রহণ করাতে আপাত কোন আপত্তি থাকার কথা না বলে বোধ করি।

ততদিন পর্যন্ত এই তিন পাড়ার ৩৬ পরিবার যারা গত দশদিনেরও বেশি সময় ধরে অনাহারে আছেন, পাহাড়ের আলু, লতাপাতা খেয়ে দিনাতিপাত করছেন, তাদের খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য সহায়তা দরকার। আজ পাহাড়ের মারমা, খেয়াং, ম্রো এবং তঞ্চংগ্যা ছাত্রছাত্রী সংগঠনগুলোর (বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, বাংলাদেশ খেয়াং স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ তঞ্চংগ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম) সম্মিলিত উদ্যোগে জরুরি ভিত্তিতে ৩৬টি পরিবারে ৫০ কেজি করে চাল এবং পরিবার প্রতি ৫০০ টাকা অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে। মাত্র চারদিনের পরিকল্পনার মাথায় সমন্বয় সাধন করে এই কাজটি সম্পূর্ণ করা কঠিন হলেও তারা তাৎক্ষনিকভাবেই মাঠে নেমে কাজটি করতে সক্ষম হয়েছে, সাধুবাদ প্রাপ্য তাদের। আর সাংবাদিক দাদারা ঘটনার সূত্রপাত থেকেই তৎপর ছিলেন বলে এই ঘটনাটি সবার গোচরে আনা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে উশেথোয়াই দাদা মাঠ পর্যায়ের হালনাগাদ তথ্য দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে সহায়তা করেছেন উদ্যোগ গ্রহণকারী ছাত্রছাত্রী সংগঠনসমূহকে।

এই তিন পাড়ার পরিবারগুলোর জুমের পুরো বছরের খোরাক কিন্তু এক বস্তা চালে পুরোবে না। উশেথোয়াই দাদা জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের সময় যা কিছু সামান্য টাকা পরিবার কয়েকটিকে দিয়ে এসেছেন, সে টাকা দিয়ে তারা তাদের পরিবারের অনাহার-ক্লিষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুদের জন্য ওষুধ কিনেছিলেন, খাবার কিনতে পারেননি। তাই ৫০০ টাকা মোটেও যথেষ্ট নয়, যা কেবলমাত্র স্টপ গ্যাপ ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে যেন বিকল্প কোন পথ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভুক্তভোগী পাড়াবাসী খেয়ে বাঁচতে পারে। এই মানবিক সহায়তা চলমান রাখা জরুরি যতদিন পর্যন্ত না সরকারি পর্যায়ে এর একটি ন্যায্য সুরাহা হয়। (চাকমা সার্কেল চীফ সহধর্মিণী রানী ইয়েন ইয়েন এর লেখনি সূত্রে)