-আবু জাফর বিশ্বাস
সূর্যের মতো দীপ্তিমান হতে হলে প্রথমে সূর্যের মতোই পুড়তে হয়। না পোড়ালে সোনাও খাঁটী হয় না। আর আগুন কখনো চেপে রাখা যায়না, ধূমিয়ে-ধূমিয়ে একসময় সে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। তেমনি প্রতিভা কখনো আবদ্ধ করে দমিয়ে রাখা যায় না, একদিন সে বিস্ফোরিত হয়ে বিশ্বকে আলোকোজ্জ্বল করে তোলে। পিতৃবিয়োগের পর যে রাখাল ছেলেটি মাঠে গরু-ছাগল রাখতো; যার হাতে থাকার কথা শুধুই লাঠি, তিনি রাখতেন বাঁশি এবং সাথে বই! লেখাপড়া শেখার অতীব আগ্রহ তাকে তাড়া করতো, তাই একসময় বাড়ী থেকে পালিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই অদম্য ইচ্ছা ও মনোবল তাকে এক সময় সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। তাই বলা হয়- ‘ইচ্ছা শক্তিই সাফল্যের চাবিকাঠি’। সেই রাখাল ছেলেটি যার হাতের যাদুকরী আড়বাঁশি বাজিয়ে সুমধুর সুরে একসময় গ্রামের ছেলে-মেয়েদেরকে সামনে হাজির করতো, ঠিক তেমনি তার সাহিত্য সাধনা ও লেখনীর শক্তি দিয়ে সাহিত্যের টানে সাহিত্যপ্রেমী মানুষগুলো একত্রিত করেছেন। যাঁর কথা বলতে চাচ্ছি তিনি আমাদের চৌগাছার গর্ব, সর্বাধিক প্রকাশিত বর্তমান ১৩ খানা বই। যিঁনি তিলেতিলে নিরবে নিভৃতে গড়ে তুলেছেন সাহিত্যের ভান্ডার! যাঁর সৃজনশীল লিখনীতে উঠে এসেছে সমাজের যত ক্ষত, সমস্যা, সম্ভাবনা, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। দেখিয়েছেন আলোর পথ, দূর হয়েছে পাঠকের মনের অন্ধকার, সৃষ্টি হয়েছে আলোকিত মানুষ। তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন প্রিয়জন সুহৃদ বিশিষ্ট কবি অধ্যাপক আব্দুস সালাম। জন্ম ১৯৪৬ সালে ১লা এপ্রিল যশোর জেলা চৌগাছা উপজেলার বাদেখানপুর গ্রামের মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বর্তমান চৌগাছা বাকপাড়ার বাসিন্দা। ২০২১সালে একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত তাঁর লেখা “জীবনের স্মৃতিকথা” বইটি পড়ে জানতে পারলাম অনেক অজানা তথ্য। পড়ালেখার জীবনটা ছিল খুবই কষ্টের! বালি পথে খালি পায়ে স্কুলে যেতে পায়ে পড়তো ঠুলা! পড়ার জন্য ছিলনা যথেষ্ট বই, পড়তে পারিনি প্রাইভেট, রাত জেগে উদাহরণ পড়ে পড়ে শিখতেন অংক। গায়ে ছিলনা ভালো জামা। পরিক্ষার ফি-বেতন দিতে না পারাই পড়েছেন বিড়ম্বনায়। এমন প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করে শিকড় থেকে শিখরে উঠার স্বপ্ন পূরণে আজ তিনি সার্থক। শুধু শিক্ষায় নয় ব্যক্তি ও কর্ম জীবনে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। একজন গর্বিত পিতা হিসাবেও তিনি অহঙ্কারের দাবিদার। দুই পুত্র ও দুই কন্যার জনক। এক পুত্র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, আরেকজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দুই কন্যাই কলেজের অধ্যাপিকা। অধ্যাপক আব্দুস সালাম স্যার ছেলেবেলা থেকেই কর্মজীবনে পদার্পণ করেছেন! প্রতিটা কাজেই রয়েছে বিরল দৃষ্টান্ত। যাবতীয় কৃষিকাজে ছিল তাঁর সুচারু অভিজ্ঞতা। স্কুলে গান-গজল গেয়ে পেয়েছেন পুরস্কার। তাবলীগ জামাতে চিল্লায় গিয়েছেন। করেছেন মসজিদের মোয়াজ্জেম ও ঈমামতি। সারা রাত জেগে পড়াশুনা করে ক্লাসে ফাস্টবয়। থেকেছেন লজিং মাস্টার হিসাবে এবং পড়ালেখার খরচ যোগিয়েছেন টিউশনি করে। পারদর্শী শর্ট-হ্যান্ড টাইপরাইটার। ছিলেন একজন সুদক্ষ ক্রিকেট খেলোয়াড়। তিনি একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতেও গিয়েছিলেন কিন্তু তেমন সুযোগ না পেয়ে ফিরে আসেন। তবে ৯মাস যুদ্ধ চলাকালীন মাথায় টোকা, কাচি-নিড়ানি হাতে কৃষক সেজে বা কখনো মুখে দাড়ি, গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি ও কাঁধে রূমাল দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে গোয়েন্দা হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন। তিনি করেছেন শিক্ষাকতা, একসময় ছিলেন চৌগাছা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ। অবসরে তিনি সাহিত্য সাধনা করতেন। প্রকাশ করেছেন তার বহুমুখী প্রতিভার পঁচাত্তর বছরের জ্ঞানগর্ভ অভিজ্ঞতার ইতিহাস, নতুন প্রজন্মকে দিয়েছেন উপহার নিজের লেখা বই। কবির অনেক বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের নাম- নীলপদ্ম (২০১৫), তোমারি প্রেমের জন্য (২০১৬), ভালোবাসা কাহারে কয় (২০১৬), সেই স্বপনের দেশে (২০১৭), মহাপ্রেমের মহাকাব্য (২০১৮), তোমার জন্য স্বপ্ন বিলাস (২০১৯), স্মৃতির কাঁটা (২০২০), লকডাউনে একাএকা (২০২১) সৃষ্টির সন্ধানে, (যৌথ) (২০২২) অধ্যাপক আব্দুস সালাম ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি করতেন এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতেন। লেখালেখিতে তিনি উৎসাহ পেয়েছেন ততকালীন কবি “এম আহমদ আলী” সাহিত্যরতœ’র কাছথেকে। যিঁনি ছিলেন একজন কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। আমরা যদি আমাদের অতিত জীবনের কর্ম-পরিশ্রমের কথা চিন্তা করি দেখবো এমন হাড়ভাঙা পরিশ্রম কখনওই করিনি। তাই নিশ্চয় সফলতার মাপকাঠিতে তাঁর তুলনায় ধরাছোঁয়ার অনেক নীচেয় পড়ে আছি। ‘কেউ অসাধারণ হয়ে জন্মায় না, তার কর্মই তাকে অসাধারণ করে তোলে’! আমরা তাই এমন মহৎ মানুষদের সান্নিধ্য লাভ করে ঋদ্ধতার সাথে শ্রদ্ধা জানাবো এবং তাঁর সকল ভালো কর্মে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে বাস্তব জীবনে অনুসরণ-অনুকরণ করার চেষ্টা করবো। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য লালনে এমন সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আসুন আমাদের লিখনীর মাধ্যমে বিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে দেই বাংলা ভাষার জ্ঞানগর্ভ সৃষ্টি ও সংস্কৃতি। কুসংস্কার অন্ধকার দূরে ঠেলে এগিয়ে যাব হীরকচূর্ণ আলোর পথে। খুঁজবো এমন প্রতিভাবান মানুষ। হাঁটবো আলোর দিকে, গড়বো জীবনটাকে।
আমার ধারনা, এমন গুণীজনকে নিয়ে একসময় হয়তো হবে গবেষণা, একদিন পাবে মরণোত্তর সম্মাননা। আমি মনে করি এমন গুণীজনদের আমরা যদি শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে যথাযথ সম্মান না করি তবে হয়তো একদিন দেশে আর কোনো গুণী ব্যক্তিই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই মরণোত্তর নয়, আসুন জীবিতাবস্থায় তাদেরকে সংবর্ধনা দিয়ে মূল্যায়ন এবং সম্মানিত করি। অধ্যাপক আব্দুস সালাম স্যার-এর লেখা কবিতা গল্প জীবনের স্মৃতিকথা আমরা যতই পড়ি প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত হই। তাঁর জীবন আদর্শ আমাদের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাক।
গত ২৪ জানুয়ারী তিঁনি স্বজনদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন নাফেরার দেশে! মহান আল্লাহ্ পাক উঁনাকে জান্নাতুল ফিরদউস নসিব করুন। আমীন..।
আপনার মতামত লিখুন :