ArabicBengaliEnglishHindi

৭১-এর রণাঙ্গন ও স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ২৬, ২০২২, ২:০৮ অপরাহ্ন / ৭০০
৭১-এর রণাঙ্গন ও স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার

-আবু জাফর বিশ্বাস
স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার যশোরের চৌগাছা। চৌগাছা হলো মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান। সর্বশেষ্ঠ ট্যাংক যুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধ হয় এই চৌগাছাতে। ৬ই ডিসেম্বর যশোর মুক্তির সহায়ক এই চৌগাছা। জানা যায় চৌগাছায় সর্বপ্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয় এবং দেশ স্বাধীন হবার আগেই শত্রুমুক্ত হয় যশোরের চৌগাছা। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে টিকতে না পেরে যশোর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাকসেনারা। যশোরের মাটিতে উড়ানো হয় বিজয়ের প্রথম পতাকা। মানুষের গনবিদারী ‘জয়বাংলা শ্লোগান’ প্রকম্পিত করে আকাশ-বাতাস। হাজার-হাজার মানুষ রাস্থয় নেমে আসে মুক্তির আনন্দে ও পাক হানাদারমুক্ত প্রকৃতির নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর জেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা চৌগাছায় ছিল পাক হানাদার বাহিনীর অন্যতম ঘাঁটি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এলাকা স্বাধীন করতে প্রাণপণ লড়াই করে। বিচ্ছিন্ন ভাবে পাক সেনাদের সাথে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয় চৌগাছার বিভিন্ন এলাকায়। ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেয় জগন্নাথপুর (বর্তমান মুক্তিনগর) আমবাগান এলাকায়। যশোরের রণাঙ্গনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি সংঘটিত হয় চৌগাছার জগন্নাথপুর ও মসিয়ূর নগরে। ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর মুক্তি ও ভারতীয় বাহিনীর উভচর ট্যাংকগুলো বয়রা সীমান্তের কপোতাক্ষনদ পার হয়ে যশোর সেনানিবাস দখলের অভিযান শুরু করে। ঝিকরগাছার ছুটিপুর থেকে মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস লক্ষ্য করে কামানের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। সেনানিবাসকে অবরুদ্ধ করতে বয়রা-কাবিলপুর ও গরিবপুর হয়ে এগোতে থাকে ট্যাংকবাহিনী। এদিন ছিল ঈদের দিন। সকালে চৌগাছার জগন্নাথপুরের মানুষ তৈরি হচ্ছে ঈদ উদযাপনের জন্য। এমনই এক সময় হানাদার পাকবাহিনীর ২০/২৫টি গাড়ি ঢোকে জগন্নাথপুর (বর্তমানে মুক্তিনগর) গ্রামে। ঈদের দিন মানুষ নামাজ পড়বে, মিষ্টিমুখ করবে, এটাই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাখির মত লুটিয়ে পড়েছে মানুষ। রাতে বড় ধরনের যুদ্ধ হয়, নীরব নিস্তব্ধ জগন্নাথপুর গ্রাম সহসাই প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোলাগুলির শব্দে। চলে ভয়ংকর যুদ্ধ, ছোট সিংহঝুলি (বর্তমান মসিয়ূর নগর) সহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামও পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। হুদা ফতেপুর (গরীবপুর) গ্রামের যুদ্ধাহত ও মাশিলা হাইস্কুলের সাবেক সহকারী শিক্ষক আমজাদ হোসেন জানান, ২০নভেম্বর ছিল শনিবার, ঈদুল ফিতরের দিন, সেদিন দুপক্ষের সমুখ যুদ্ধ শুরু হয়। পরদিন ২১নভেম্বর রবিবার তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে, ওইদিনই সেলের ছার্রা এসে লেগে আমি মারাত্মকভাবে আহত হই, এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়! তারপর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বনগাঁ হাসপাতালে পাঠানো হয়। জানা যায় ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাসহ ৫৭ জন সাধারণ জনগন মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মধ্যে ১৯ জন মত গ্রামের নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষের নাম জানা গেছে। স্মৃতিফলকে উল্লেখিত মুক্তিনগর রণাঙ্গনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা হলেন- শহীদ সুজাউদ্দৌলা বীর মুক্তিযোদ্ধা, আসাদুজ্জামান মধু, আব্দুর রাজ্জাক, আবুল হোসেন, রেজাউল ইসলাম, মহিউদ্দিন দেওয়ান, মুন্সি কপিল উদ্দিন, বিশু মন্ডল, খোকা বারিক, আলতাপ হোসেন, জহির উদ্দিন, হাসান আলী, তাহের আলী, করিমন নেছা, রহিমা খাতুন, ভানু বিবি, ছইরন নেছা, আয়শা আক্তার। ২১শে নভেম্বর স্থানীয় জগন্নাথপুর গ্রামে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর মধ্যে এক বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়! প্রচুন্ড গোলাগুলির শব্দের সঙ্গে হাজারো সৈন্যের গগণবিদারী চিৎকার, আর চেঁচামেচি। দীর্ঘসময় ধরে যুদ্ধ চলায় গোলা-গুলি যখন শেষের দিকে, এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ চলে আসে কাছাকাছি, একশ গজের মধ্যে। জগন্নাথপুর আমবাগান, বর্তমান স্কুল মাঠে শুরু হয় হাতাহাতি, মল্লযুদ্ধ! সরাসরি রাইফেলের বেয়নেট ও বাট দিয়ে পিটাপিটির এক পর্যায়ে অস্ত্র ছাড়াই হয় হাতা-হাতি, লাথা-লাথি, কিল-ঘুষি, কুস্তা-কুস্তী, মল্লযুদ্ধ। রক্তাক্ত হয় আম্রকানন মাঠ! জানা যায় মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের অন্যতম এবং একমাত্র মল্লযুদ্ধর স্থান এই জগন্নাথপুর। এ যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে মুুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের আলী বলেন এই অঞ্চলের ভায়বহ যুদ্ধ হয় এখানে। মুক্তিযোদ্ধাসহ মিত্র বাহিনী ও পাক বাহিনীর মধ্যকার চলমান যুদ্ধে গোলাবারুদ শেষ হলে উভয়ই মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধটি ছিল অত্যান্ত ভয়াবহ। আমার জানামতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ইতিহাসে মল্লযুদ্ধ কোথাও হয়নি। বাংলাদেশের সামরিক একাডেমিতে মল্লযুদ্ধের বিষয়টি পড়ানোর পাশাপাশি যুদ্ধের ধরণ ও প্রকৃতি সম্মন্ধে সেনা সদস্যদের জানানো হয়। যুদ্ধের বিষয়ে ‘মুক্তিনগর শহীদ স্মরণী মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এর প্রধান শিক্ষক শাহাজান আলী বলেন এই অঞ্চলের ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এখানে। এই যুদ্ধ নজিরবিহীন। মুক্তিযোদ্ধাসহ মিত্রবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যকার চলমান যুদ্ধে গোলাবারুদ শেষ হলে উভয়ে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ২২ নভেম্বর আবারও বিমান হামলা চালায় পাকবাহিনী। মিত্রবাহিনীও পাল্টা বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের দুইটি জেট জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করে, একটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে ২ জন পাইলটও বন্দি হয়। ধ্বংস করে আরও ৭টি সোফে ট্যাংক ও বহু সাঁজোয়া গাড়ি। অনেক গোলা-বারুদ ফেলে রেখে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী। মিত্রবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গাড়ে জগন্নাথপুরে। এ যুদ্ধে দু’পক্ষের সহস্রাধিক সৈনিক মারা যায়। মুক্তিবাহিনী এরপর মিত্রবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হামলার পর হামলা চালাতে থাকে। এগিয়ে যেতে থাকে যশোরের অভিমুখে। পাক সেনারা সলুয়া বাজারে ঘাঁটি করে ওখান থেকে যুদ্ধ করতে থাকে। এক সময় ওই ঘাঁটিও ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ইতিহাসে এটি জগন্নাথপুর-গরীবপুরের যুদ্ধ নামে খ্যাত। যেহেতু তুমুল যুদ্ধে ইতোমধ্যে পাক বাহিনীর চৌগাছার ঘাঁটি দখল করে নেয় যৌথবাহিনী, হানাদার মুক্ত হয় চৌগাছা, তাই ২২শে নভেম্বর দেশের প্রথম মুক্ত অঞ্চল হিসেবে চৌগাছাকে ‘স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার’ বলেন অনেকেই। এলাকাবাসী উক্ত ২২শে নভেম্বরকে স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার চৌগাছা মুক্ত দিবস হিসাবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান চলে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর। এ তিন দিন যশোর অঞ্চলের আড়পাড়া সহ বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর যুদ্ধ হয়। এ সময় মিত্রবাহিনীও সীমান্ত এলাকা থেকে যশোর সেনানিবাসসহ পাক আর্মিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। ৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাক হানাদাররা। শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। তাই ৬ই ডিসেম্বর বলা হয় যশোর মুক্ত দিবস। যশোরের মাটিতে সেদিন উড়ানো হয় বিজয়ের প্রথম পতাকা। মানুষের গগনবিদারী ‘জয়বাংলা শ্লোগান’ প্রকম্পিত করে আকাশ-বাতাস। হাজার-হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে মুক্তির আনন্দে। স্বাধীনের পরেও জগন্নাথপুরে ২টি সোফে ট্যাংক পড়েছিল বহুদিন ধরে। একটি ট্যাংক আগুন ধরে পোড়া, আর একটি শুধুই চেন কাটা ছিল। ১৯৭৬ সালে ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর যশোর জেলার জেলা প্রশাসক হয়ে আসার পর তিনি ট্যাংক দুটি দেখতে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে ৬ই ডিসেম্বর বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে কবি শামসুর রহমানের “স্বাধীনতা তুমি” কবিতাটি স্মৃতিফলকে স্থাপন করেন। উল্লেখ্য কবি শামসুর রহমান ১৯৮০সালে এখানে আসেন। ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর ১৯৭৯ সালে জগন্নাথপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ‘মুক্তিনগর’ রাখেন এবং নিজ উদ্যোগে শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য “মুক্তিনগর শহীদ স্মরণী মাধ্যমিক বিদ্যালয়” ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮৭ সালে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে বিদ্যালয়টি সরকারী স্বীকৃতি প্রাপ্ত ও এম.পি.ও ভুক্ত হয়। এর পর জগন্নাথপুর গ্রামের আম্রকানন (মুক্তিনগর) পরিদর্শনে আসেন ভারতীয় সেনা প্রধান শংকর রায় চৌধুরী। তিনি এ এলাকায় ১৯৭১ সালে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। বিখ্যাত সেই আম্রকানন বড় বড় আমগাছ এখন আর সেখানে নাই। এখানে নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার স্মৃতিফলক, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, ও ‘মুক্তিনগর শহীদ স্মরণী মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পরে আমাদের গ্রাম জামালতার পাশেই জগন্নাথপুর আম বাগানে যে ট্যাংক দুটি পড়ে ছিল; আমি নিজেও ট্যাংক দুটি দেখেছি। যতদিন ছিল আমরা ওই ট্যাংকে চড়ে খেলা করতাম। ট্যাংকের গুলি করা নলের উপর উঠে ঘুরতাম, খুব মজা হতো। মাঠের মধ্যে বাংকারে (পরিখা) পড়ে থাকতে দেখিছি বহু গুলিগোল্লার খাপ, মাইন, সেলের কৌটা ও ফোনের তার। আমার বয়স তখন ৯-১০বছর। নয় মাস যুদ্ধের কথা সব মনে আছে। যখন দুই পক্ষের যুদ্ধ হতো বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ হতো। সবাই ঘরের মধ্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকতাম। গুলি-ছার্রা এসে জানালায় ঠকাস-ঠকাস করে লেগে পড়ে থাকতো। জানালায় আলাদা তক্তা বেঁধে রাখা হতো, যাতে গুলি ভিতরে না আসতে পারে। রাতের বেলা মনে হতো আকাশের তারাগুলো খসে খসে মাটিতে পড়ছে। অমাবস্যা রাতেও আকাশে আলোর ঝলকানি, আর বাতাসে শুধুই বারুদের গন্ধ। একদিন আমাদের বাড়ীর উঠানের পরদিয়ে সিংহঝুলির দিক থেকে লাইন দিয়ে পাঞ্জাবি যেতে থাকে, বাড়ীর পিছনদিক যেতেই ঠাশ-ঠুশ, ডেডা-ডেডা, প্রচুর গুলির শব্দ। সবার ভয়ে বুক ধকধক করতো, না-জানি কখন সেল এসে মাথায় পড়ে! মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়ানো সেই ভয়াবহ দুঃসময়ের অনুভূতির কথা এখন ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না।আমাদের গ্রামের উত্তরে সিংহঝুলি গ্রাম, ওই গ্রামেই ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের মধ্যে ‘একমাত্র শহীদ, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য’ শহীদ মশিয়ুর রহমানের বাড়ি। ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে তাঁর নিজ গ্রাম চৌগাছার সিংহঝুলিতেও নির্দয় পাক হানাদার বাহিনীরা এসে অনেক অত্যাচার নির্যাতন করে, অনেকগুলো বাড়ী-ঘর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আমি নিজেও দেখেছি গ্রামটিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে। লোকজন ভয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করছে। ছুটে চলে আসে আমাদের গ্রামের দিকে। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একমাত্র পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য- মেম্বার ওফ ন্যাশনাল এসেম্বলি (এমএনএ) যাঁকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ২৫মার্চ ১৯৭১ সেই ভয়াল কালো রাতে যশোরের সিভিল কোর্ট মসজিদ সংলগ্ন নিজ বাসভবন “সিংহঝুলি কুঠির” থেকে গ্রেফতার করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়, এবং প্রায় এক মাস নির্মম, নিষ্ঠুর, পৈশাচিক ভাবে নির্যাতন করে। ১৯১৭সালে জন্মগ্রহণকারী এই মানুষটির নাম শহীদ মশিয়ূর রহমান। মাত্র ৫৪বছর বয়সে ১৯৭১সালের ২৩শে এপ্রিল তাঁকে হত্যা করা হয়! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২সালের ১০ই জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং ঐ বছরই যশোর আসেন। মহান বিজয়ের মাসে ২৬শে ডিসেম্বর। তাঁর সারা জীবনের বিশ্বস্ত সহকর্মী শহীদ মশিয়ুর রহমান স্মরণে যশোর পৌর পার্কে স্মৃতিফলকের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন এবং বঙ্গবন্ধু ঐ দিনই যশোর স্টেডিয়ামে স্মরণকালের এক ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষণ দেন। পরবর্তীতে তার নামে ঝিকরগাছায় একটি কলেজ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র হল, চৌগাছা ডিগ্রি কলেজের একাডেমিক ভবন, ও তার জন্মভূমি সিংহঝুলিতে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ‘মশিয়ূর নগর’ রাখা হয়েছে। তৎকালীন রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু হাতে গোনা দুই একজনকে আপনি বা ভাই বলে সম্বোধন করতেন, তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ মশিয়ুর রহমান এবং দুজনের চেহারার হুবহ এক অদ্ভুত মিলও ছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ভাষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন আন্দোলনে কারাবরণকারী এই ভাষা সৈনিক, শহীদ মশিয়ূর রহমান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা ও প্রাণোৎসর্গকারী ত্রিশ লক্ষ শহীদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম। ১৯৭১ সালে চৌগাছার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন পিতম্বরপুরের (গরীবপুর) বিশিষ্ট কলামিস্ট তৎকালীন মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক মিজানুর রহমান (মধু), তিনি তখন যশোর এম.এম কলেজে পড়তেন, যুদ্ধের সূচনালগ্নে দুজন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সিপাহীকে নিয়ে ভারতে চলে যান, এবং মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর বন্ধু চিপহুইপ বিপ্লবী অমর ঘোষের বাড়ীতে উঠেছিলেন। ওখানে থেকে বনগাঁতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কোলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং-এ অনুষ্ঠিত মন্ত্রীদের মিটিং-এ তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথে তাঁরও থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল বলে জানান, এবং ভারতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দর সাথে একাধিবার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তিনি কোলকাতা অস্থায়ী সরকার অফিস, ‘৮নং থিয়েটার রোড’ থেকে মুক্তি যোদ্ধাদের রসদ যোগান দিতেন। ওখান থেকে খাদ্য-খাবার টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে বনগাঁয় ১নং টালিখোলা থেকে ৫নং টালিখোলা ও চাঁপাবাড়িয়া নামক স্থানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পৌছে দিতেন। তার সাথে থেকে সহযোগীতা করতেন চৌগাছা সিংহঝুলি গ্রামের হাফিজুল্লা (কালন)। মিজানুর রহমান (মধু) বলেন মুক্তিযুদ্ধ চলার ৩ মাস মত পরে একদিন সন্ধ্যায় ছইরদ্দীকে নিয়ে তার নিজ গ্রাম পিতম্বরপুর আসেন, এবং এলাকার পরিস্থিতি ও পাকবাহিনীর খোজ-খবর নিয়ে তিনি ফিরে যান বনগাঁয়। ওখানে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন তাঁর গ্রামের পাশেই নাতনার খাল ব্রিজটি ভেঙে গুড়িয়ে দেবার জন্য। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা এসে চৌগাছা-ঝিকরগাছা রোডের নাতনার খাল নামক ব্রিজটি মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি আবার দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ওখান থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। পরবর্তীতে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। বর্তমান তিনি খ্যাতিমান সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে পরিচিত। ‘ভোরের কাগজ’ থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য পেয়েছেন সম্মাননা স্মারক।
-আবু জাফর বিশ্বাস। কবি, লেখক ও সংগঠক।
চৌগাছা, যশোর।
তথ্যসূত্র:- আমার দেখা, মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাতকার ও স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে লেখা।