এম রাসেল সরকার ->>
পেশায় পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিয়মানুবর্তীতা আর শৃঙ্খলাবদ্ধ এই পেশায় নিজের মেধার সাক্ষরও রাখছেন। তবে হাবিবুর রহমানের পরিচয় ছাপিয়ে গেছে সমাজসেবামূলক মানবিক নানান কর্মকাণ্ডে।
অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান। এমন গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যও সর্বদা নিবেদিত প্রাণ তিনি। পাশাপাশি লেখালেখির মতো সৃষ্টিশীল কর্মেও সমান সক্রিয়।
হাবিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষকে তাদের সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করছেন। বিশেষ করে অসহায়, দরিদ্র, বেদে জনগৌষ্ঠী, হিজড়াদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে নানা ভূমিকা রেখে চলেছেন।
কর্মক্ষেত্রেও উজ্জ্বল সাক্ষর হাবিবুর রহমানের। তার উদ্যোগে যুগান্তকারী নানা পদক্ষেপ পুলিশে এনেছে অনেক পরিবর্তনও। গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি দায়িত্ব সফলভাবে পালন করে আসা এই পুলিশ কর্মকর্তার পেশাগত সাফল্য তাকে নিয়ে গেছে ঈর্ষণীয় অবস্থানে।
মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান। নিজ গ্রামের মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই তার প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবন।
এস এম মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৭তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে ১৯৯৮ সালে কর্মজীবন শুরু করা হাবিবুর রহমান সারদাতে প্রশিক্ষণকালে সকল সহকর্মীদের প্রিয় হয়ে ওঠেন।
নেতৃত্ব আর সৃজনশীলতা দিয়ে প্রশিক্ষণ সুপিরিয়র ‘আমার হলো শুরু’র সম্পাদক নির্বাচিত হন। যেখানে নিজের গবেষণা লেখা প্রকাশ পায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশের শেকড় সন্ধানী ইতিহাস, ঐহিত্য ও করণীয় সম্পকৃত নানান দিক তুলে ধরা হয়।
প্রশিক্ষণ শেষ করে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে প্রথম কর্মস্থল শুরু হয়। এরপর ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) হিসেবে পদায়নের পর হাবিবুর রহমান ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
২০০১ সালে ভোলায় এএসপি হিসেবে দায়িত্ব পান এই পুলিশ কর্মকর্তা। পরের বছর উদ্দিপ্ত ক্যারিয়ারে আঘাত আসে। তবুও থেমে থাকে না হাবিবুর রহমানের স্বপ্নযাত্রা। পুনরায় তার কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়।
ডিএমপির ডিসি হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে কর্মরত অবস্থায় নিজের মেধা ও নেতৃত্বগুণে তিনি সাধারণ মানুষ, সহকর্মী ও অধস্তন পুলিশ সদস্যদের কাছে হয়ে ওঠেন একজন সৃজনশীল, পজেটিভ ও মানবিক পুলিশি সেবার উজ্বল নক্ষত্র।
২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর হাবিবুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অভিনব সব কর্মকৌশল অবলম্বন করেন। চলমান অসঙ্গতি ও সংগঠিত অপরাধকে দমন করার পাশাপাশি সম্ভাব্য অপরাধ প্রতিরোধ করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। তার নেওয়া এসব উদ্যোগ আজও ধারাবাহিকভাবে চলমান।
হাবিবুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেকে এনে মাত্র একশ টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেন; যা নিয়ে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেন। সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে উচ্চ প্রশংসা পান।
২০১৬ সালে হাবিবুর রহমান অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পুলিশ সদরদপ্তরে পদায়িত হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্ব পান।
দীর্ঘ তিনবছর তিন মাসের বেশি সময় দায়িত্ব পালন শেষে গেল বছরের ১০ অক্টোবর অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে হাবিবুর রহমান তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। পুলিশের চাকরির পাশাপাশি লেখালেখিতেও সক্রিয় অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান।
গত ৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চিঠিপত্র: শেখ মুজিবুর রহমান’ ও একই বইয়ের ইংরেজি সংস্করন ‘লেটারস অব শেখ মুজিবুর রহমান’ এর মোড়কও উম্মোচন করেন। এই বই দুটি সম্পাদনায় হাবিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. এনায়েত করিম।
ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বই দুটির মোড়ক উম্মোচন করেন। এর আগে হাবিবুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’ সম্পাদনা করেন।
‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ নামে তার গ্রন্থিত আরেকটি বইয়ে প্রথমবারের মতো বিস্তারিত উঠে আসে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বইটি সম্পাদনায় মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন হাবিবুর রহমান। এছাড়াও হাবিবুর রহমানের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ঠার’ আলোচিত। এই বইয়ে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন।
হাবিবুর রহমানের মানবিকতা:
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের হাট বাসুদেবপুর গ্রামে সান্দার বেদে গোত্রের প্রায় ২০০টি পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করেন; যাদের শতভাগ মুসলমান। অথচ এই জনগোষ্ঠীর কেউ মারা গেলে মুসলমান হিসেবে তাদের সৎকারটুকুও করতে পারত না। পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে আশপাশের কোনো কবরস্থানে তাদেরকে কবর দিতে দেওয়া হতো না। এমন করুণ অবস্থা জানতে পরে নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি পুলিশের এই কর্মকর্তা। তিনি সহকর্মীদের সহযোগিতায় একটি জায়গা খুঁজে পান, যেটি কিনে দান করে দেন এই জনগোষ্ঠীর ২০০ পরিবারের কল্যাণে।
তাছাড়া ২০২০ সালের শুরুতে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় বহু পুরনো যৌনপল্লীতে প্রথমবারের মতো একজন যৌনকর্মীর পুরোপুরি ইসলামি প্রথা মেনে জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হয়। পরে চেহলামেরও আয়োজন করা হয়। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হিসেবে করে দিয়েছেন পশু খামার। তাছাড়া অনেককে গার্মেন্টসে চাকরি, পার্লার ও খাবার দোকানের ব্যবসা গড়ে দিয়েছেন। এসব উদ্যোগের নেতৃত্ব রয়েছেন মানবিক পুলিশ হিসেবে সুনাম পাওয়া হাবিবুর রহমান। এখন নতুনভাবে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীর শিশুদের জন্য কাজ শুরু করেছেন তিনি। যার সুফলও মিলছে। বিশেষ করে যৌনপল্লীর শত শত শিশুকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তার হাতে গড়া ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন’।
রাজারবাগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর:
হাবিবুর রহমানের একক প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে টেলিকম ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় পুলিশ মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর, যা এক ঐতিহাসিক স্থাপনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকেই তার এই উদ্যোগ। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এটি সর্বসাধারণের প্রবেশের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি “জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ ২০১৭”-এর উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নব-নির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন।
যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাঙ্ক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেলসহ অনেক কিছু সংরক্ষণ আছে।
হাবিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত পুলিশ থিয়েটারের ‘বিশ্বরেকর্ড’:
একবছরে শততম বার মঞ্চায়ন করে দেশব্যাপী সাড়া জাগিয়েছে পুলিশ থিয়েটারের কালজয়ী নাটক ‘অভিশপ্ত আগস্ট’। মঞ্চ নাটকটির পরিকল্পনা, গবেষণা ও তথ্য সংকলন করেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি ২০১১ সালে যখন ডিএমপির সদরদপ্তরের ডিসি ছিলেন তখন পুলিশ থিয়েটারটি প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ, এখন পর্যন্ত একবছরে কোনো থিয়েটার গ্রুপ শতবার কোনো নাটক মঞ্চায়িত করতে পারেননি।
আপনার মতামত লিখুন :